রাঙামাটি
কাপ্তাই হ্রদে পর্যটক নিয়ে চলে দেড় শতাধিক অবৈধ নৌযান, ঘটছে দুর্ঘটনা
রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে দেড় শতাধিক নৌযান অবৈধভাবে চলাচল করে আসছে। নিবন্ধনহীন এসব নৌযানে নিয়ম মানার বালাই নেই। যে কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা, এমনকি প্রাণহানিও ঘটছে।
সময় তখন দুপুর ১২টা। ঘাট থেকে হুড়োহুড়ি করে একটি দোতলা নৌকায় উঠে পড়লেন ৪৩ জন পর্যটক। কেউ ছাদে, কেউ নৌকার ভেতরে। নৌকাটিতে ৮টি লাইফ জ্যাকেট, যদিও কোনোটাই গায়ে দেননি কেউ।
গত শুক্রবার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের ঝুলন্ত সেতু এলাকায় দেখা যায় এমন দৃশ্য। ছাদে যাত্রী নিয়ে, লাইফ জ্যাকেট ছাড়া, এভাবেই কাপ্তাই হ্রদে নিয়মিত চলাচল করে পর্যটকবাহী নৌযান।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা জানান, ঠিক কী পরিমাণ নৌযান কাপ্তাই হ্রদে চলাচল করে এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব তাঁদের কাছে নেই। তবে এর আনুমানিক সংখ্যা দুই শর বেশি। এর মধ্যে যাত্রীবাহী ৩৯টি লঞ্চ (বড় নৌকা) ও ১০টি স্পিডবোটের নিবন্ধন রয়েছে। দেড় শতাধিক নৌযান চলাচল করে আসছে অবৈধভাবে। নিবন্ধনহীন এসব নৌযানে নিয়ম মানার বালাই নেই। যার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা, এমনকি প্রাণহানিও ঘটছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পর্যটকবাহী অধিকাংশ নৌযানে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট নেই। কাপ্তাই হ্রদে দ্বিতল নৌযান চলার ওপর বিআইডব্লিউটিএর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ঝুলন্ত সেতুর নিচ থেকে ৪৩ পর্যটক নিয়ে যাত্রা শুরু করা নৌযানটির চালক মো. কাউছারের কাছে জানতে চাওয়া হয় লাইফ জ্যাকেট কম থাকার বিষয়ে। তিনি বলেন, পর্যটকদের অনেকেই লাইফ জ্যাকেট পরতে চান না। তাই নতুন করে আর লাইফ জ্যাকেট কেনেননি। নৌযানে থাকা ৮টি লাইফ জ্যাকেট নিয়ে কোনোভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন। শিগগিরই কিছু লাইফ জ্যাকেট কিনবেন।
নৌযানের মালিকদের বারবার নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে। দোতলা নৌযান তৈরি না করার জন্য নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ আইনের তোয়াক্কা করছেন না।আকবর হোসেন, বিআইডব্লিউটিএর সার্ভিস সুপারভাইজার।
একই এলাকায় ইঞ্জিনচালিত আরেকটি নৌকাকে দেখা যায় ৪৮ জন পর্যটক নিয়ে হ্রদে ঘুরে বেড়াতে। সেখানে লাইফ জ্যাকেট ছিল মাত্র ৬টি। নৌযানটির চালক শফিকুল ইসলাম বলেন, কিছু লাইফ জ্যাকেট নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আপাতত কম। লাইফ জ্যাকেট কেনার চেষ্টা চলছে।
লাইফ জ্যাকেট না থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বেশ কিছু পর্যটক। ঢাকার মতিঝিল থেকে আসা ট্যুর অপারেটর আরিফুর রহমান বলেন, ‘বোট ভাড়ার সময় সবাইকে লাইফ জ্যাকেট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা পাওয়া যায়নি।’
তদারকি নেই, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি
অবৈধ এসব যানে বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সুবলং থেকে রাঙামাটি শহরে ফেরার পথে শিশুসহ ১৯ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌযান ডুবে যায়। যদিও এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
এর আগে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ ডিসি বাংলো এলাকায় নৌযান উল্টে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আলাউদ্দিন পাটোয়ারী ও তাঁর স্ত্রী আইরিন লিমার মৃত্যু হয়। ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানা থেকে সুবলং ভ্রমণে যাওয়ার পথে নিহত হন ছয় কর্মী। ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা থেকে বেড়াতে এসে নৌ দুর্ঘটনায় দুই বোনের মৃত্যু হয়।
দুর্ঘটনা এড়াতে ২০২০ সালে কাপ্তাই হ্রদে চলাচলকারী নৌযানের ছাদে যাত্রী নিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। তবে সেই নির্দেশনা রয়েছে শুধু কাগজে-কলমে। রাঙামাটি উপজাতীয় টেম্পোবোট মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি পলাশ চাকমা বলেন, তাঁদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত ৩৫টি নৌযান রয়েছে। ছোট নৌযানে সর্বনিম্ন ৬ জন এবং বড় নৌযানে সর্বোচ্চ ১০০ জন যাত্রী বহনের সক্ষমতা আছে। তাঁর দাবি, সব নৌযানেই লাইফ জ্যাকেট ও ডাস্টবিন রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
রিজার্ভ বাজার ট্যুরিস্ট বোট মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি রমজান হোসেন বলেন, তাঁদের সমিতির অধীনে নৌযান রয়েছে ৪০টি। গত শুক্রবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জরুরি সভা ডেকে লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার, জরাজীর্ণ নৌযান মেরামত, পর্যটকদের সঙ্গে ভালো আচরণ ও ছাদে যাত্রী কম তোলার নির্দেশনা দিয়েছেন।
নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে এ পর্যন্ত ৭০ থেকে ৭৫টি মামলা করা হয়েছে জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর সার্ভিস সুপারভাইজার আকবর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নৌযানের মালিকদের বারবার নিবন্ধন করতে বলা হচ্ছে। দোতলা নৌযান তৈরি না করার জন্য নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছে। তবে কেউ আইনের তোয়াক্কা করছেন না।
পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং দুর্ঘটনা এড়াতে পর্যটকবাহী নৌযানের মালিকদের নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাঙামাটি জেলা শাখার সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য লাইফ জ্যাকেটসহ অন্যান্য উপকরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে।’