উপকূলে সরকারি পানিবণ্টনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি
মীরা ও তাঁর স্বামী দুজনই দিনমজুর। পড়ন্ত বিকেলে পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করার আগে দিনমজুরের কাজ করে আসতে হয়েছে মীরাকে। গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে সরদারবাড়ির এই পুকুর থেকে মীরার মতো অনেকেই পানি সংগ্রহ করেন। তাঁদের বাড়ির আশপাশের কোথাও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা নেই। মীরা বলেন, এখান থেকে পানি নিয়ে বাড়ি আসতে-যেতে ঘণ্টাখানেক লাগে। গরম আসছে, চিন্তা বাড়ছে। পানির ট্যাংক পাওয়ার জন্য অনেকের কাছে বলেছেন; কিন্তু কাজ হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বাড়ায় উপকূলের ১৯টির মধ্যে ১৮ জেলার শতাধিক উপজেলায় খাওয়ার পানির সংকট রয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট ক্রমাগত বাড়ছে। এসব কারণে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত পানির ট্যাংক যেন সোনার হরিণ। সেই সোনার হরিণ পেতে পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি, গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। অনিয়ম আর দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে আছে উপকূলের মানুষের খাওয়ার পানির উৎস। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন এই অবৈধ বাণিজ্যে।
সুন্দরবন উপকূলের কাছে বসবাস করা হাজারো মানুষ খাওয়ার পানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে পুকুর থেকে কাদামাখা লবণাক্ত পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এখানকার পুকুরগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে ফিটকিরি দিয়েও সেই পানি পুরোপুরি পানযোগ্য করা যায় না।
অথচ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই সুবিধা পৌঁছেছে খুব কম মানুষের কাছে। কারণ, এসব প্রকল্পের প্রতিটি স্তরে রয়েছে অনিয়ম আর দুর্নীতি।
সরকারিভাবে নির্ধারিত ১ হাজার ৫০০ টাকা সহায়ক চাঁদা এবং পরিবহন খরচ তো আছেই, উপরন্তু দিতে হচ্ছে ঘুষ।
বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে কোথাও কোথাও পুকুর পুনঃখনন করা হয়েছে। তবে তা কাজে আসছে না। ‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টারের’ (পিএসএফ) বেশির ভাগ অকেজো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পানির ট্যাংক পাওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের দিতে হচ্ছে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা। সরকারিভাবে নির্ধারিত ১ হাজার ৫০০ টাকা সহায়ক চাঁদা এবং পরিবহন খরচ তো আছেই, উপরন্তু দিতে হচ্ছে ঘুষ। রাজনৈতিক পরিচয়, জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠতা অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক—এগুলোই যেন পানির ট্যাংক পাওয়ার প্রধান শর্ত। এমনকি ট্যাংকের গায়ে ‘ক্রয়-বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ লেখা থাকলেও দেদার চলছে এই অবৈধ ব্যবসা।
দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের বিকাশ মণ্ডল সাত-আটবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখন ঝুলন্ত ঘরে (মাটির ওপর তৈরি নয়; নদীর চরে কাঠের পাটাতন এবং গোলপাতার বেড়া দিয়ে তৈরি) বসবাস করেন। পানির কষ্ট তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি বলেন, ‘আমরা পানি একটু চেপেচুপে খাই। দেড় গেলাস খাইলে ভালো হয়; দেখা গেল এক গেলাসে সেরে দিলাম।’
মানুষের আগ্রহ সরকারের দেওয়া ৩ হাজার লিটারের ট্যাংকের প্রতি। খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২০২৫ সালের এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বিভিন্ন ধরনের মোট ৭৬ হাজার ৫৫৯টি পানির উৎস আছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ১১২টি গভীর নলকূপ, ১৩ হাজার ৪২৬টি অগভীর নলকূপ, ১ হাজার ৩৯০টি পিএসএফ, ৩২ হাজার ৬৩৬টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে রিভার্স অসমোসিস (আরও) ইউনিট, সোলার ডি-স্যালানাইজেশন ইউনিট, এসএসটি, সোলার পিএসএফ, পুকুরখনন, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে সরকারি হিসাবে ১২ হাজার ৭৩টি খাওয়ার পানির উৎস অকেজো হয়ে আছে। বর্তমানে জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না।
‘উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি; বরং সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা তাঁদের নিজস্ব তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী উঠান বৈঠক, ওয়ার্ডসভা, ইউনিয়নের পানি ও পয়োনিষ্কাশন (ওয়াটসান) কমিটির মাধ্যমে তালিকা তৈরির কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি।
আমরা পানি একটু চেপেচুপে খাই। দেড় গেলাস খাইলে ভালো হয়; দেখা গেল এক গেলাসে সেরে দিলাম।বিকাশ মণ্ডল
বরাদ্দ কীভাবে, কাদের পাওয়ার কথা
খুলনায় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম (ঘরের চালার ওপর পড়া বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে ট্যাংক বা পাত্রে ধরে রাখার পদ্ধতি) স্থাপনের বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রকল্প উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প। খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা, পাইকগাছা, তেরখাদা, ডুমুরিয়া ও রূপসা উপজেলায় এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পে ৪০ হাজার ৫টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৫ হাজার ৮৩৩টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় পাইকগাছায় ৯ হাজার ৭৯২, কয়রায় ৮ হাজার ১৯২, দাকোপে ৫ হাজার ৮২৬, ডুমুরিয়ায় ৫ হাজার ৪৯০, তেরখাদায় ৪ হাজার ৯২৬, রূপসায় ৩ হাজার ২৪৫ ও বটিয়াঘাটায় ২ হাজার ৫৩৪টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করার কাজ চলছে।
এ প্রকল্পে উপজেলায় বরাদ্দকৃত ট্যাংকের ৫০ শতাংশের তালিকা দিয়েছেন সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। বাকি ৫০ শতাংশ বণ্টন করা হয় উপজেলা পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন (ওয়াটসান) কমিটির মাধ্যমে। ওই কমিটির সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সহসভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সদস্যসচিব উপজেলা জনস্বাস্থ্যের সহকারী বা উপসহকারী প্রকৌশলী। তবে উপজেলা ওয়াটসান কমিটির জন্য বরাদ্দকৃত ট্যাংকের ১০-২০ শতাংশ উপজেলা চেয়ারম্যানের জন্য রেখে বাকিগুলো দেওয়া হতো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের তালিকা অনুযায়ী।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কারা পাবেন, এখানে একেবারে সুস্পষ্ট করে তা না থাকায় বাস্তবায়নে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
নিয়মানুযায়ী তালিকা যাওয়ার পদ্ধতি হলো প্রথমে উঠান বৈঠক, এরপর ওয়ার্ডসভা, ওয়ার্ড ওয়াটসান কমিটি, ইউনিয়ন ওয়াটসান কমিটি, তারপর সেখান থেকে উপজেলা। কিন্তু এই প্রক্রিয়া কোথাও অনুসরণ করা হয়নি। প্রকল্পের একটা নির্ধারিত সময় থাকায় কর্মকর্তারাও এত সব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে আগ্রহ দেখান না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে।
কারা এই ট্যাংক পাবেন, সেটা নিয়েও সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। ২০২৪ সালে ‘সমগ্র দেশে পানি সরবরাহ প্রকল্পের’ মুখবন্ধে যেভাবে লেখা আছে, সেটাকেই নীতিমালা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেখানে নলকূপ/পানির উৎস স্থাপনের স্থান নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে, তার তিন নম্বর পয়েন্টে আছে, ‘অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় বসবাসকারী এবং আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে নলকূপ/পানির উৎস স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কারা পাবেন, এখানে একেবারে সুস্পষ্ট করে তা না থাকায় বাস্তবায়নে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
আগের মেম্বার ও তাঁর এক চ্যালার কাছে আগে দুই দফায় টাকা দিয়েও ট্যাংক পাননি। এ বছর টাকা দিয়ে ট্যাংক একটা হয়েছে। তবে কার মাধ্যমে বাড়িওয়ালা (স্বামী) এনেছে, সেটা বলতে পারব না।সুমিত্রা সরদার
ট্যাংক পাওয়া যায় যেভাবে
স্বজনপ্রীতি ও টাকার বিনিময়ে জলাধার বিক্রির চিত্র জেলার প্রায় সব জায়গাতেই আছে। শুধু টাকা নয়, সুন্দরবনের টাটকা মাছ আর খাঁটি মধুর বিনিময়েও কেউ কেউ ট্যাংক নিতে পারছেন।
দাকোপে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ৫ হাজার ৮২৬টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ২ হাজার ৫২৪টি সিস্টেম স্থাপন শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। সাতটি ধাপে এই রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে। প্রথম তিন ধাপে ২ হাজার ৫৭৪টি ট্যাংকের অর্ধেক খুলনা-১ আসনের (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) সাবেক সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাস বরাদ্দ দিয়েছেন। পরের তিন ধাপের ২ হাজার ৪৪৩টির অর্ধেক বরাদ্দ দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডল। সপ্তম বা শেষ ধাপের ৮০৯টির তালিকা ননী গোপাল মণ্ডল জমা দেওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
সংসদ সদস্যের তালিকার বাইরে বাকি অর্ধেক তালিকা উপজেলা ওয়াটসান কমিটির সুপারিশে ইউপি চেয়ারম্যানরা দিয়ে থাকেন।
দাকোপ এলাকায় প্রতি ১০ জনের সঙ্গে কথা বললে ৯ জনই বলেন, টাকা ছাড়া ট্যাংক মেলে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের আস্থাভাজন ব্যক্তিরাই এই বাণিজ্যের মূল হোতা। টাকা দিয়েও অনেকে ট্যাংক পাননি, আবার কেউ কেউ কিছু টাকা ফেরত পেয়েছেন।
গুনারী সরদার বাড়ির পুকুরে সুমিত্রা সরদার রান্নার জন্য পানি নিতে এসেছিলেন। এ বছর সুমিত্রা সরকারিভাবে একটি পানির ট্যাংক পেয়েছেন। তবে এ জন্য টাকা খরচ করতে হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আগের মেম্বার ও তাঁর এক চ্যালার কাছে আগে দুই দফায় টাকা দিয়েও ট্যাংক পাননি। এ বছর টাকা দিয়ে ট্যাংক একটা হয়েছে। তবে কার মাধ্যমে বাড়িওয়ালা (স্বামী) এনেছে, সেটা বলতে পারব না।’
টাকা দিয়েও ট্যাংক না পেয়ে হতাশ অনেকে। রামনগর গ্রামের কানাই মণ্ডল বলেন, ‘গুনারী গ্রামের মৃণাল হালদার কাদের যেন ম্যানেজ করে ট্যাংক দেয়। অনেককেই দিয়েছে। আমার পরিবার ও স্বজনের জন্য দুটো ট্যাংক বাবদ মৃণাল হালদারের কাছে অগ্রিম আট হাজার টাকা দিই। ট্যাংক দিতে না পারায় মাত্র তিন হাজার টাকা ফেরত দিয়েছে।’
আবার একশ্রেণির মানুষ ও কিছু জনপ্রতিনিধি উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস থেকে বরাদ্দের তালিকা দেখে আসেন। এরপর তাঁরা তালিকায় ইতিমধ্যে যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের অনেকের কাছে টাকা চেয়ে থাকেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের কর্মীদের বিরুদ্ধেও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ আছে।
বাণীশান্তা ও কৈলাসগঞ্জ ইউনিয়নের দুই ইউপি সদস্য বলেন, বিগত দিনে তাঁদের সুযোগ ছিল না ট্যাংক দেওয়ার। চেয়ারম্যান একক সিদ্ধান্ত নিয়ে সব ট্যাংক বিতরণ করতেন। মেম্বারদের হয়তো এক-আধটা নাম দেওয়ার সুযোগ ছিল। তাঁরা বলেন, ‘এসবে আর্থিক লেনদেন হয়, এটা তো ওপেন সিক্রেট।’
শুধু সাধারণ মানুষই নন, সরকারি চাকরিজীবী ও জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতেও দেখা গেছে সরকারি এই পানির ট্যাংক। উপজেলার ৩০ জন জনপ্রতিনিধি ও ১০ আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতেই সরকারি এই পানির ট্যাংক আছে। জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে ট্যাংক থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে কৈলাসগঞ্জের ইউপি সদস্য অমিত মণ্ডল জানান, চেয়ারম্যান প্রত্যেক মেম্বারকে একটি করে ট্যাংক দিয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বরাদ্দের কোটা কম থাকায় তাঁদের নজর থাকে সংসদ সদস্যদের কোটার দিকে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পঞ্চানন বিশ্বাস বটিয়াঘাটার বাসিন্দা হওয়ায় দাকোপে তিনি খুব কম যেতেন। তবে তাঁর কাছে কেউ ট্যাংকের আবেদন নিয়ে এলে তিনি তাতে সুপারিশ করে দিতেন। এ ছাড়া তাঁর অনুসারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান এমনকি ইউপি সদস্যের মাধ্যমে কেউ এলে কাজ হয়ে যেত। দলীয় নেতা-কর্মীর পরিচয়েও অনেকেই তাঁর কাছ থেকে ট্যাংক পেয়েছেন। এসব নেতা-কর্মীর অনেকেই যাঁদের ট্যাংক পাইয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে এ বাবদ টাকা নিয়েছেন।
কেউ কেউ আবার যোগাযোগ করতেন পঞ্চানন বিশ্বাসের ছেলে বটিয়াঘাটা ইউপির চেয়ারম্যান পল্লব কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে। পঞ্চানন বিশ্বাসের এপিএস দেবাশীষ মণ্ডলের বিরুদ্ধে ট্যাংক দেওয়ার নামে টাকাপয়সা নেওয়ার অভিযোগ আছে। দাকোপ অঞ্চলের বেশ কিছু চিহ্নিত মানুষ দেবাশীষের মাধ্যমে ট্যাংক নিয়ে দিতেন। এর জন্য তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন। পঞ্চানন বিশ্বাস ও পল্লব বিশ্বাস বর্তমানে নিজ এলাকায় আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা হয়নি। তবে সম্প্রতি দুদকে পঞ্চানন বিশ্বাসের নামে একটি মামলা হয়েছে।
দীপ্ত মণ্ডল মূলত টাকা তুলিয়েছেন বিভিন্ন ইউনিয়নের ইউপি সদস্যদের দিয়ে। এ ছাড়া তাঁর কাছের ‘ভাই-বন্ধুরা’ এর সঙ্গে জড়িত। তাঁর বাবা আগেও একবার সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা আলাদা বলয় ছিল।
এমপির ছেলের পকেটে ট্যাংকের টাকা
আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডলের নিজের ইউনিয়ন কৈলাসগঞ্জ। ওই ইউনিয়ন পরিষদের দুই ইউপি সদস্য বললেন, তাঁদের ইউনিয়নেই মেম্বারদের ভেতর দু-তিনজন আছেন যাঁরা টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছেন। সেই টাকা ননী গোপাল মণ্ডলের ছেলে দীপ্ত মণ্ডলের কাছে হস্তান্তরও হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে এ রকম আছে। দুজনই জানান, অনেকে তাঁদের কাছে ট্যাংকের জন্য টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা নেননি। ননী গোপাল মণ্ডল বর্তমানে ভারতে আছেন বলে শোনা যায়।
দীপ্ত মণ্ডল মূলত টাকা তুলিয়েছেন বিভিন্ন ইউনিয়নের ইউপি সদস্যদের দিয়ে। এ ছাড়া তাঁর কাছের ‘ভাই-বন্ধুরা’ এর সঙ্গে জড়িত। তাঁর বাবা আগেও একবার সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা আলাদা বলয় ছিল। এ জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে কমবেশি তাঁদের নিজস্ব লোক বা কর্মী ছিল। তাঁদের মাধ্যমেই টাকা সংগ্রহ হয়েছে। একেকটি ট্যাংকের জন্য সাড়ে তিন হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা নিয়েছেন তাঁরা। জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য অফিস থেকে চাহিদা চাওয়ার পর এক মাস সময় নিতেন। এই সময় ধরে তাঁরা তালিকা প্রস্তুত করতেন। তাঁরা যে পরিমাণ ট্যাংক দিতে পারবেন বলে মনে করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি লোকের কাছ থেকে টাকা তুলেছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনে সেসব মানুষকে আর ট্যাংক দিতে পারেননি।
লাউডোবের একজন ইউপি সদস্য বলেন, ‘দীপ্তর সঙ্গে যারা ঘুরত, তারা আমাদের কাছে প্রথম দিকে ট্যাংক দেওয়ার প্রস্তাব দিত। আমাদের ইউনিয়নের মেম্বারদের কাছ থেকে সুবিধা করতে পারেনি। তবে তাঁর আশপাশে যারা ছিল, তারা অনেকের কাছ থেকে টাকা তুলেছে। এখন কেউ ট্যাংক পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না।’
অন্য একজন ভুক্তভোগী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে থেকেই রাজনীতি করি। এমপির নির্বাচনেও সব সময় ছিলাম। তাই মানুষের একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। আমি আমার মামা, মাসি, ভাইবেরাদার, আত্মীয়স্বজনদের মোট ২৪ জনের নাম দিছিলাম। এ জন্য দীপ্ত মণ্ডলের কাছে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। ট্যাংক পেলাম না।’
একজন ভুক্তভোগী জানান, তিনি মুঠোফোনের আর্থিক সেবা বিকাশের মাধ্যমে দীপ্ত মণ্ডলকে ৩টি ট্যাংক পাওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তাঁদের আইডি কার্ডগুলোও দীপ্ত মণ্ডলের হাতে হাতে দিয়েছেন বলে জানান।
দীপ্ত মণ্ডল এখন ভারতে আছেন। উপজেলা যুবলীগের একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের কাছ থেকে ট্যাংকের টাকা নিয়ে সংসদ সদস্যের ছেলে তো হানিমুন করে বেড়িয়েছেন। ননী গোপালের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন দাকোপে তাঁর ছেলে দীপ্ত মণ্ডল আর বটিয়াঘাটায় তাঁর মেয়ের জামাই অনুপম মণ্ডল।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিটি পানি সংরক্ষণ ইউনিট স্থাপনে খরচ ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ট্যাংক, প্রয়োজনীয় পাইপ, ট্যাপ, পাকা পাটাতন নির্মাণ থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিবহন, শ্রমিক খরচ সবই আছে।
মামলার বেড়াজালে প্রতারণার শিকার
সরকারি ঘর ও পানির ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে প্রতারণার শিকার হয়ে গত বছরের ২৯ নভেম্বর খুলনার দাকোপে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেন বানীশান্তা ইউনিয়নের হাফিজুল শেখ। মামলায় খুলনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডল ও তাঁর ছেলে দীপ্ত মণ্ডলসহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের গড়খালী গ্রামের জনি সরদার ও একই গ্রামের ছবেদ আলী সরদার। হাফিজুলের অভিযোগ, আসামিরা ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েও প্রতিশ্রুতি রাখেননি।
হাফিজুল জানান, জনি সরদার নামে এক ব্যক্তি তাঁর বাড়িতে এসে টাকা নিয়েছিলেন। জনি আবার ননী গোপাল মণ্ডলের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন এবং দীপ্ত মণ্ডলের সঙ্গে ট্যাংকের বিষয়ে কথাও বলেছিলেন। তাই তাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন, টাকা দিলে ট্যাংক পাওয়া যাবে।
হাফিজুল জানান, প্রতিটি ট্যাংকের জন্য প্রথমে ৪ হাজার করে আর পরে আরেক দফায় ১ হাজার টাকা করে দিয়েছেন। একেকটা ঘরের জন্য দিয়েছেন ৬৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা করে।
তবে ট্যাংক পাওয়ার জন্য শুধু টাকা দিলেই হতো না, পরিবহনের খরচও বহন করতে হতো উপকারভোগীদের। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেরই ট্যাংক পৌঁছে দেওয়ার কথা। কিন্তু দাকোপে কোনো উপকারভোগীই এই সেবা পাননি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিটি পানি সংরক্ষণ ইউনিট স্থাপনে খরচ ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ট্যাংক, প্রয়োজনীয় পাইপ, ট্যাপ, পাকা পাটাতন নির্মাণ থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিবহন, শ্রমিক খরচ সবই আছে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিটের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা সহায়ক চাঁদার বাইরে ট্যাংকের পেছনে আর কোনো খরচ হওয়ার কথা নয়। এই চাঁদা ব্যতীত অন্য কাজ যেমন পাটাতন নির্মাণ, মালামাল পরিবহন, অতিরিক্ত ফিল্টার কেনা, খাওয়া, যাতায়াত ভাতা ও অন্যান্য বিষয় বাবদ কোনো প্রকার অর্থ গ্রহণ এবং প্রদান অবৈধ। এমন নির্দেশনাসহ একটা নোটিশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবনের বিভিন্ন জায়গায় লেখাও আছে।
‘রাজনীতির ট্যাংক’
আগে দেওয়া ট্যাংকগুলোতে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত খাবার পানি সংরক্ষণের জলাধার’ লেখা থাকত। বর্তমানে সেই লেখা আর নেই। অনেক সময় রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে জনসমক্ষে ট্যাংক বিতরণ করা হতো, যেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত থাকতেন এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাতেন।
দাকোপের একজন ইউপি সদস্য বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা ভোটের হিসাব–নিকাশের স্বার্থে অনেক সময় মানুষের মনোরঞ্জন করার জন্য ট্যাংক দিয়ে দিয়েছে। অনেক সময় ভোটের রাজনীতির একটা বিষয় থাকত।’
জেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোটারদের তুষ্ট রাখতে ট্যাংক দেওয়া হয়েছে।
খুলনায় অবস্থিত সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চের চেয়ারপারসন গৌরাঙ্গ নন্দী বলেন, ‘এমপিদের বেশি বরাদ্দ দেওয়ার কারণেই এসব প্রকল্পে রাজনীতি বেশি ঢুকেছে এবং দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও একটি ট্যাংক মানে একটি পরিবারের ভোট—এমন ধারণার কারণেও এর অপব্যবহার হয়।’
উপকূলের মানুষের একটাই চাওয়া—যেন তাঁরা ন্যায্যভাবে সুপেয় পানি পান এবং সরকারি সহায়তা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দুর্নীতি বা অনিয়ম না হয়।
এখনো অনিয়ম
সরকার পরিবর্তনের পরও উপকূলের মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। ট্যাংক বিতরণে আর্থিক অনিয়ম এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে এবার চরিত্র বদল হয়েছে। আগের সংসদ সদস্যদের দেওয়া তালিকা এখনো চলছে, কিন্তু নতুন করে অন্য দলের প্রভাবশালী নেতারা সেই তালিকা মানতে নারাজ।
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়ে চাপে আছেন। আবার ঠিকাদারদের অনেকে এখন প্রকাশ্যে নেই। আগের এমপিদের দেওয়া তালিকা বাদ দিলে ঠিকাদারেরা এবং তাঁরা বিপাকে পড়বেন। ফলে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি কামারখোলা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুর ইসলামের বিরুদ্ধে ট্যাংক দেওয়ার কথা বলে টাকা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, যা সামাজিক যোগাোযগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। নুর ইসলাম ঘটনাটিকে ‘ভুল–বোঝাবুঝি হয়েছে’ বলে প্রথম আলোকে জানান।
উপকূলের মানুষের একটাই চাওয়া—যেন তাঁরা ন্যায্যভাবে সুপেয় পানি পান এবং সরকারি সহায়তা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দুর্নীতি বা অনিয়ম না হয়।