নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলায় ভাঙনের ঝুঁকিতে সেতু–শ্মশান

হাজিরহাট শ্মশানের পাশে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে গত রোববার থেকে মেশিন বসিয়ে বালু তুলে রাস্তায় দেওয়া হচ্ছে।

যশোরের মনিরামপুরের হাজিরহাট এলাকায় মুক্তেশ্বরী নদী থেকে যন্ত্র দিয়ে বালু তুলে সড়ক ভরাট করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় মুক্তেশ্বরী নদী থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। যন্ত্র দিয়ে তোলা সেই বালু ফেলা হচ্ছে নির্মাণাধীন সড়কে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে উপজেলার হরিদাসকাটি ইউনিয়নের হাজিরহাট এলাকায় মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত হাজিরহাট সেতু এবং নদীর পাড়ে অবস্থিত হাজিরহাট শ্মশান।

হাজিরহাট শ্মশান কমিটির কোষাধ্যক্ষ তপন কুমার মণ্ডল বলেন, হাজিরহাট শ্মশানের পাশে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে প্রায় তিন বছর আগে বালু তুলে রাস্তায় দেওয়া হয়েছিল। গত রোববার থেকে একই জায়গায় মেশিন বসিয়ে বালু তুলে রাস্তায় দেওয়া হচ্ছে। বালু তুলতে বারবার নিষেধ করেছেন। বাধা দিয়েছেন। তারপরও বালু তোলা হচ্ছে। এভাবে বালু তোলা অব্যাহত থাকলে হাজিরহাট শ্মশান নদীর মধ্যে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রাস্তায় বালু দেওয়ার জন্য আমি এক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম। তিনি কীভাবে বালু দিচ্ছেন, আমি ঠিক জানি না। নদী থেকে বালু তুললে যদি অসুবিধা হয়, তাহলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
শেখ মো.আবদুল্লাহ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী

মনিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাটি ইউনিয়নের হাজিরহাট এলাকার পাকা রাস্তা থেকে বাহিরডাঙ্গাপাড়ার পশুপতির বাড়ি পর্যন্ত ইট দিয়ে সড়ক পাকা করার কাজ চলছে। ৭৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা ব্যয়ে সড়কটির ১ কিলোমিটার ২১৫ মিটার ইট দিয়ে দুই স্তর পাকাকরণের কাজ হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর গ্রামীণ মাটির রাস্তাগুলো টেকসই করার লক্ষ্যে ‘হেরিং বোন বন্ড বা এইচবিবি’ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রকল্পের কাজ এটি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মনিরামপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

উপজেলার পাঁচকাটিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুব্রত রায় বলেন, হাজিরহাট শ্মশান এবং সেতুর কাছে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলে রাস্তায় দেওয়া হচ্ছে। এতে যেকোনো সময় শ্মশান নদীর মধ্যে ভেঙে পড়তে পারে। তাঁরা বাধা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কথা কেউ শুনছেন না।

যশোরের চৌগাছা উপজেলার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শেখ এন্টারপ্রাইজ সড়কটি নির্মাণ করছে। সড়কটির দুই পাশে মাটি দিয়ে বেঁধে উঁচু করা হয়েছে। এখন চলছে সড়কের মাঝের নিচু অংশ বালু দিয়ে ভরাটের কাজ। ঠিকাদার নিয়ম বহির্ভূতভাবে মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তুলে সড়ক ভরাটের কাজ করছেন।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স শেখ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শেখ মো.আবদুল্লাহ বলেন, ‘রাস্তায় বালু দেওয়ার জন্য আমি এক ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করেছিলাম। তিনি কীভাবে বালু দিচ্ছেন, আমি ঠিক জানি না। নদী থেকে বালু তোলা ঠিক নয়। নদী থেকে বালু তুললে যদি অসুবিধা হয়, তাহলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’

বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০–এর ভাষ্য অনুযায়ী, বিপণনের উদ্দেশে কোনো উন্মুক্ত স্থান, চা–বাগানের ছড়া বা নদীর তলদেশ থেকে পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। এ ছাড়া সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারাজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা অথবা আবাসিক এলাকা থেকে বালু ও মাটি উত্তোলন করা যাবে না (শর্ত ক্ষেত্রে শিথিল)।

গত মঙ্গলবার দুপুরে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, হাজিরহাট সেতুর পূর্ব পাশে শ্মশানের সামনে মুক্তেশ্বরী নদীতে ভাসছে একটি পাটাতন। তেলের কয়েকটি ড্রামের ওপর তক্তা বিছিয়ে বাঁশের সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয়েছে পাটাতনটি। ভাসমান পাটাতনে দুটি বালু তোলার যন্ত্র (ডিজেলচালিত অগভীর নলকূপের মোটর) বসানো হয়েছে। একটি যন্ত্র থেকে পাইপ নদীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই পাইপ দিয়ে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। অপর যন্ত্রটি পানির সঙ্গে সেই বালু প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে সামনে ঠেলে দিচ্ছে। প্রায় ৪০০ মিটার দূরে বালু গিয়ে পড়ছে সড়কে। বালু পড়ে উঁচু হচ্ছে সড়কের নিচু অংশ। নদীতে বালু তোলার কাজ তদারকি করছিলেন চারজন শ্রমিক।

শ্রমিকদের একজন আবু বক্কার বলেন, তাঁদের বাড়ি সাতক্ষীরার তালা উপজেলায়। দিনে জনপ্রতি ১ হাজার টাকা মজুরিতে তাঁরা গত রোববার থেকে নদী থেকে বালু তুলে রাস্তা ভরাট করছেন। রাস্তা ভরাট হতে আরও কয়েক দিন লাগবে।

মনিরামপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এস এম আবু আবদুল্লাহ বায়েজিদ বলেন, সড়কটিতে সব জায়গায় ছয় ইঞ্চি বালু ভরাট করার কথা। বালুর জন্য টাকা বরাদ্দ আছে। কিন্তু কোথাও এক ফুট এবং কোথাও দেড় ফুট পরিমাণ বালু লাগছে। ঠিকাদার বালু কিনে সড়কে দিচ্ছেন। তবে ঠিকাদার নদী থেকে বালু তুলছেন কি না, তা তিনি জানেন না।

এদিকে গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত নদী থেকে বালু তোলার কাজ চলছিল।

জানতে চাইলে মনিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন বলেন, ‘নদী থেকে বালু তোলার নিয়ম নেই। মুক্তেশ্বরী নদী থেকে বালু তোলার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়ে সেটি বন্ধ করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বালু তোলা বন্ধ ছিল। বিকেলে বালু তোলার বিষয়টি আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’