পাসপোর্ট কর্মকর্তার কলার চেপে নেতা বললেন, ভুঁড়ি বের করে ফেলব

কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপপরিচালককে হেনস্থার জের ধরে দিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়।রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালককে হুমকি ও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার বিরুদ্ধে।

আজ রোববার সকালে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। ওই কর্মকর্তা জানান, কয়েকটি ফাইলে জোর করে তাঁর স্বাক্ষর নিতে চেয়েছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা। একপর্যায়ে ভুঁড়ি বের করে ফেলার হুমকি দেন তিনি।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট কার্যালয়ে এ ঘটনায় দিনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্নিত হয়। অধৈর্য হয়ে সেবাগ্রহীতারা ক্ষোভও প্রকাশ করেন। অনেকে দীর্ঘক্ষণ সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও কাজ না করতে পেরে হইহুল্লোড়, চিৎকার–চেঁচামেচি শুরু করেন।

পাসপোর্ট কার্যালয়ের ভুক্তভোগী উপসহকারী পরিচালকের নাম আজিজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকাল আনুমানিক সাড়ে ১০টায় তিনি তাঁর কার্যালয় কক্ষে নাশতা করছিলেন। এ সময় ঝিনুক আহমেদ নামের এক ব্যক্তি নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে কয়েকটি ফাইলে দ্রুত স্বাক্ষর করে দিতে বলেন। খাবার খাচ্ছেন জানিয়ে তখন ঝিনুককে অপেক্ষা করতে বলেন তিনি (কর্মকর্তা)।

আজিজুল হক বলেন, ‘অপেক্ষা করতে বললে ঝিনুক খাবার খাওয়ার সময়েই আমার শার্টের কলার ধরে বলেন, “তাড়াতাড়ি সই কর, না হয় পার দিয়ে তোর ভুঁড়ি বের করে ফেলব।” লাঞ্ছিত করার পাশাপাশি অকথ্য ভাষায় গালাগালও করেন ওই নেতা। হঠাৎ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। কী করব বুঝতে পারিছলাম না। বিষয়টি নিয়ে এখন আতঙ্কে আছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঝিনুক আহমেদ কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। পাসপোর্ট কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে দুপুর থেকে মুঠোফোনে তাঁকে অসংখ্যবার কল করেও পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বিকেলে তাঁকে পাওয়া যায়। তাঁর দাবি, তিনি কাউকে হুমকি বা লাঞ্ছিত করেননি। তবে তাঁর কাছে পাসপোর্ট ফরমের ফাইলে সইয়ের জন্য ঘুষ চাওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে কিছুটা বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছে।

ঝিনুকের ভাষ্য, সকালে তিনি তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তির পাসপোর্টের ফরম নিয়ে উপসহকারী পরিচালকের কাছে যান। তখন দালালের হাত ধরে আসা অনেক ফরমে তিনি স্বাক্ষর করে দিলেও তাঁর (ঝিনুকের) ফরমে স্বাক্ষর করতে গড়িমসি করেন। তখনই বাগ্‌বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়।

প্রথম আলোকে ঝিনুক বলেন, ‘আকার–ইঙ্গিতে ওই কর্মকর্তা ঘুষ দিতে বলেন। জানান, কোনো আনসার বা অফিসের কাউকে ৫০০ টাকা দিয়ে দিলেই নাকি তাড়াতাড়ি আমারটা স্বাক্ষর হয়ে যেত। এটা শোনার পর আমি রেগে যাই। আর তাঁর সঙ্গে আমার বাগ্‌বিতণ্ডা হয়।’ নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ঝিনুক বলেন, ‘উনি সরকারি কর্মকর্তা, উনাকে কেন আমি হুমকি আর শার্টের কলার ধরে টানাটানি করব। বরং উনারাই প্রতিদিন শত শত সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের নানা অজুহাতে কষ্ট দিয়ে আসছেন। ঘুষ দিলেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ, নাহয় দিনের পর দিন গ্রাহকদের ভোগান্তিতে ফেলেন।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী হিসাবরক্ষক আশরাফ আলী বলেন, ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে ঝিনুক প্রতিদিন চারটা-পাঁচটা ফাইল নিয়ে আসেন। তাঁর ফাইলে স্বাক্ষর করতে দেরি করলেই তিনি নানা হুমকি ও গালাগাল করেন। এটা তাঁর নিত্যদিনের ঘটনা। তিনি বলেন, ‘ঝিনুকের এ রকম আচরণে আমরা বিরক্ত। কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকলে আমরা কীভাবে এখানে কাজ করব। আজকের বিষয়টি নিয়ে আমরা খুবই আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্যে আছি।’

বিদেশে যাওয়ার জন্য রোববার পাসপোর্ট করতে আসা কটিয়াদীর বাসিন্দা মো. কামরুজ্জামান ও অষ্টগ্রাম থেকে পাসপোর্ট করতে আসা হাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আজ সকাল থেকে পাসপোর্ট কার্যালয়ে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষমাণ শত শত সেবাগ্রহীতা ছিল। সারিতে দাঁড়ানোর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেককেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে কর্মকর্তাদের সঙ্গে একজনের ঝগড়া বাধে। এতে কয়েক দফায় কার্যক্রম বন্ধ থাকে। অনেক সেবাগ্রহীতার ফরমে সই আর ফিঙ্গার প্রিন্ট নিতে বিলম্ব হয়। যে কারণে দূরদূরান্ত থেকে আসা অনেক সেবাগ্রহীতা অধৈর্য হয়ে বাড়িতেও ফিরে যান।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আইরিন পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে ঝিনুক নামের এক লোক সকালে এসে কার্যালয়ের ভেতরে তাঁর অফিসারের ওপর হামলা, শার্টের কলার ধরে টানাটানি ও ভুঁড়ি বের করে ফেলার হুমকি দিয়ে লাঞ্ছিত করেন। এটি খুবই দুঃখজনক। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে (এডিএম) অবহিত করা হয়। এরপর থানা থেকে একজন এসআই ঘটনা তদন্তে এসেছিলেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন আইরিন।

বিষয়টি জানতে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দাউদকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ তাহলে পাসপোর্ট কার্যালয়ে পুলিশ কেন তদন্তে গেল, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ওখানে পুলিশ পাঠানো এটা তাঁদের নিয়মিত রুটিন।