জোগালি থেকে রাজেদা বেগম এখন ‘হেড মিস্ত্রি’

রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার কান্দিপাড়া গ্রামের রাজেদা বেগমছবি: প্রথম আলো

রাজেদা বেগম তখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁকে রেখে স্বামী শাহিন হোসেন দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। বৃদ্ধ মাকে দেখার দায়িত্ব ছিল তাঁর। তখন নিরুপায় হয়ে রাজেদা ২৫ টাকা মজুরিতে রাজমিস্ত্রির সহযোগী (জোগালি) হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২২ বছর পর সেই রাজেদা এখন রাজমিস্ত্রিদের দলনেতা (হেড মিস্ত্রি)। তাঁর নেতৃত্বে কমপক্ষে ১০ জন এখন কাজ করছেন।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের মশিন্দা কান্দিপাড়া গ্রামে রাজেদা বেগমের (৫০) বাড়ি। বাবা বেল্লাল সরদার অনেক আগেই মারা গেছেন। দুই ভাই বিয়ে করে পৃথক সংসার করায় বৃদ্ধ মায়ের দায়িত্ব ছিল রাজেদার। তিনি বলেন, তাঁদের কোনো জমিজমা ছিল না। ধারদেনা করে প্রতিবেশী শাহিন হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। বিয়ের প্রায় দুই বছর পর অন্তঃসত্ত্বা হন তিনি। এমন সময় স্বামী শাহিন হোসেন তাঁকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।

পরে সন্তানের ভবিষ্যৎ আর বৃদ্ধ মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে লোকলজ্জা উপেক্ষা করে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন সারা দিন কাজ করে পেতেন ২৫ টাকা। ওই টাকাতেই বৃদ্ধ মা ও নিজের খরচ জোগাতে হয়েছিল রাজেদাকে। জোগালি হিসেবে কাজ শুরু করার চার মাসের মাথায় তাঁর সন্তান হয়। মেয়ের নাম রাখেন শ্যামলী খাতুন।

রাজেদা বলতে থাকেন, মেয়ের জন্মের তিন মাস পরই তিনি কাজে নেমে যান। মেয়েকে নিয়ে কাজে যেতেন। মেয়ে খেলাধুলা করত আর তিনি কাজ করতেন। তখন অন্য জোগালিরা তাঁকে সহযোগিতা করতেন। চার বছর ধরে তিনি ‘হেড মিস্ত্রি’ হিসেবে কাজ করছেন।

কীভাবে শিখলেন এসব কাজ—জানতে চাইলে রাজেদা বলেন, দেখে দেখে সব কাজ শিখে নেন। অভিজ্ঞতার কারণে এখন সবাই তাঁকে ‘হেড মিস্ত্রি’ ডাকে। তাঁর অধীন থাকা শ্রমিকেরাও তাঁকে সম্মান করেন। এখন তিনি দিনভর কাজ করে ৫০০ টাকা পান। আর তাঁর অধীন থাকা অন্য শ্রমিকেরা ৩৫০ টাকা করে নেন।

রাজেদা বেগম বলেন, নানা চাড়ই-উতরাইয়ের মধ্যেও উপার্জনের টাকায় মেয়ে শ্যামলীকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মজুরির টাকায় বৃদ্ধ মা রাবেয়া বেগমকে নিয়ে ভালোই দিন কাটছে তাঁর। সব সয়ে পরিশ্রম করে টিকে থাকায় এখন কেউ বাঁকা চোখে তাঁর দিকে তাকায় না, সম্মান দিয়ে কথা বলে সবাই।

উপজেলা রাজমিস্ত্রি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি জয়েন উদ্দিন বলেন, রাজেদা একজন সংগ্রামী নারী। নিজের ইচ্ছায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য তাঁর কাছে এসেছিলেন। রাজেদা তাঁর পরিশ্রম, সততা ও দায়িত্বশীলতায় সবাইকে মুগ্ধ করেছেন। এ কারণে জোগালি থেকে ‘হেড মিস্ত্রি’ হতে পেরেছেন তিনি।