বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো দেখা গেল বিরল ধূসর ফ্যালারোপ পাখি

বিরল পাখি গ্রে ফ্যালারোপ। সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী উম্মে খাদিজা

রাজশাহীর আলোকচিত্রী দম্পতি মো. ইমরুল কায়েস ও উম্মে খাদিজা পদ্মা নদীতে পাখির ছবি তুলতে তুলতে পেয়ে যান একটি বিরল পাখি। ১ এপ্রিল ছবিটি তোলার পরও তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না এটা কী পাখি। তাঁরা ওই দিনই দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাখির ছবিটি পাঠান।

তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারেন, এই পাখি বাংলাদেশে অত্যন্ত বিরল। দেশে এর আগে একবার মাত্র পাখিটি দেখা গেছে। পাখিটির নাম গ্রে ফ্যালারোপ বা ধূসর ফ্যালারোপ। একে রেড ফ্যালারোপ বা লাল ফ্যালারোপও বলা হয়।

বাংলাদেশে প্রথম ২০১৩ সালে পাবনার সুজানগরে এই পাখি দেখেছিলেন বন্য প্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু। এবার রাজশাহীর পদ্মা নদীতে দেখেছেন ইমরুল কায়েস ও উম্মে খাদিজা দম্পতি।

পাখিবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৈকত-পাখিদের (শোরবার্ড) এক আজব উপপরিবারের নাম ফ্যালারোপোডিনি। বিশ্বে এই উপপরিবারে মাত্র তিন প্রজাতির পাখি আছে। রেড ফ্যালারোপ, রেড নেক ফ্যালারোপ ও উইলসনস ফ্যালারোপ। ফ্যালারোপ সমাজে স্ত্রীরাই সর্দার। স্ত্রী পাখি পুরুষ পাখির তুলনায় আকারে বড় হয় এবং রঙের উজ্জ্বলতা পুরুষ পাখির চেয়ে স্ত্রী পাখির পালকেই বেশি থাকে। স্ত্রী পাখি একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে পছন্দের পুরুষ সঙ্গীকে জয় করে নিতে। অন্য পাখিতে সাধারণত এর উল্টোটা দেখা যায়। স্ত্রী ফ্যালারোপ পাখি বাসা বাঁধার স্থান নির্বাচন করে এবং তা রক্ষা করার জন্য লড়াই করে। কিন্তু ডিমে তা দেওয়া এবং ছানা পালন করার সব কাজ পুরুষকে একাই করতে হয়।

নতুন একটি পাখির ছবি তুলতে পেরে খুশিমনে আমরা বাড়ি ফিরে আসি। রাতে দেশি ও বিদেশি পাখিবিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে পারি, আমাদের খুঁজে পাওয়া পাখিটি আসলে গ্রে ফ্যালারোপ, যা আরও বেশি দুর্লভ। পাখিটি এর আগে মাত্র একবার বাংলাদেশ দেখা গেছে। ১১ বছর পর রাজশাহীর পদ্মায় আমাদের তোলা গ্রে ফ্যালারোপ পাখির ছবিগুলো এই পাখির বাংলাদেশ অবস্থানের দ্বিতীয় সাক্ষ্য হিসেবে চিরকালের জন্য রয়ে গেল।
উম্মে খাদিজা, আলোকচিত্রী

উইলসনস ফ্যালারোপ গ্রীষ্মে দক্ষিণ আমেরিকায় এবং শীতে উত্তর আমেরিকায় বাস করে। অন্য কোনো মহাদেশে এর দেখা মেলে না। অপর দুই প্রজাতির ফ্যালারোপ অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই দেখা যায়। রেড ফ্যালারোপ শীতকালে সমুদ্রে ও উপকূলীয় নদ-নদীতে বাস করে এবং গ্রীষ্মকালে প্রজননের জন্য সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ড ও কানাডার তুন্দ্রা অঞ্চলে যায়। সমুদ্রপথে সারা বিশ্বে পরিযায়ন করে বেড়ালেও এ পাখি লম্বায় মাত্র আট ইঞ্চি। জলচর কীটপতঙ্গ ও প্ল্যাংকটন এ পাখির মূল আহার্য। সাঁতার কেটে দ্রুত চক্কর দিয়ে পানিতে ছোট ছোট ঘূর্ণি বানিয়ে এ পাখি আহার সংগ্রহ করে থাকে।

আলোকচিত্রী উম্মে খাদিজার তোলা বিরল পাখি গ্রে ফ্যালারোপের আরেকটি ছবি। সম্প্রতি রাজশাহীর পদ্মা নদীতে তোলা

শীতকালে লাল ফ্যালারোপের নামের যথার্থতা বোঝা কঠিন। শীতে এর পালকে লালের চিহ্নমাত্র থাকে না। তখন এর পেট সাদাটে, পীঠে ছাই রং এবং ঠোঁট কালো থাকে। প্রজনন ঋতুতেই কেবল এর গলা ও পেটের পালক লাল হয় এবং ঠোঁটে লাল রং ধরে।

বিশ্বে ধূসর-ফ্যালারোপের সংখ্যা ১০ লাখ বলে অনুমান করা হয়। শীতে জনহীন সমুদ্রে বিচরণ ও গ্রীষ্মে মানবশূন্য তুন্দ্রায় প্রজনন করে বলেই সম্ভবত এখনো এ পাখিকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান নিতে হয়নি।

ধূসর ফ্যালারোপ খুঁজে পাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে আলোকচিত্রী উম্মে খাদিজা প্রথম আলোকে জানান, এখন গরমের সময়, তিনি চাচ্ছিলেন প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার পাখি দেখতে পবার বায়া এলাকায় বের হবেন। কিন্তু তাঁর স্বামী বলে বসলেন, আগে পদ্মার পাখি দেখতে যাবেন। রাতেই তাঁদের নির্ভরযোগ্য গাইড ও পাখি আলোকচিত্রী অনিক মাঝির সঙ্গে কথা বলে সব বন্দোবস্ত করে ফেলা হলো। ১ এপ্রিল সকালে নদীতে নামার সময় তাঁদের সঙ্গী হলেন নবীন পাখির আলোকচিত্রী তুষার। অনেক দিন পর তিনি নদীতে নামছেন। রোদঝলমলে নীল আকাশের নিচে নীল পানি কেটে এগিয়ে চলছে নৌকা। শহর বরাবর নদীর সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন কোথায় কী কী পাখি আছে। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে এল। চর খানপুরসংলগ্ন একটি জায়গায় বেশ কয়েক ধরনের পরিযায়ী পাখির দেখা পাওয়া যায়। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সেখানে পাখির ছবি তুলতে তুলতে দিনের বাকি সময়টা পার করবেন। পাখির ঝাঁক থেকে বেশ খানিকটা দূরে ক্যামেরা হাতে কোমর পানিতে নেমে সন্তর্পণে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন পাখির ঝাঁকের দিকে। ঝাঁকের মধ্যে একটি পাখিকে দেখে একটু আলাদা মনে হচ্ছিল। কী পাখি দেখার জন্য আরও কাছে এগোতে এগোতে কায়েস তাঁদের ইশারা করলেন পাখিটার দিকে নজর রাখতে। এটি অতি দুর্লভ পাখি রেড নেক ফ্যালারোপ হতে পারে। প্রায় তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পাখিটির ভালো ছবি তুলতে সক্ষম হন তাঁরা।

প্রজনন ঋতুতে ধূসর ফ্যালারোপের গলা ও পেটের পালক এ রকম লাল হয় এবং ঠোঁটে লাল রং ধরে। মে–জুনে প্রজননের জন্য পাখিটি সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ড ও কানাডার তুন্দ্রা অঞ্চলে যায়
ছবি: সংগৃহীত

উম্মে খাদিজা বলেন, ‘যতদূর জানা ছিল, রেড নেক ফ্যালারোপ পাখিটি ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রথমবার দেখা যায়। এখন পর্যন্ত খুব অল্প কয়েকটি জায়গায় দেখা গিয়েছে। নতুন একটি পাখির ছবি তুলতে পেরে খুশিমনে আমরা বাড়ি ফিরে আসি। রাতে দেশি ও বিদেশি পাখিবিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে পারি, আমাদের খুঁজে পাওয়া পাখিটি আসলে গ্রে ফ্যালারোপ, যা আরও বেশি দুর্লভ। পাখিটি এর আগে মাত্র একবার বাংলাদেশ দেখা গেছে। ২০১৩ সালে পাবনার সুজানগরে প্রথমবার এ পাখির দেখা পাওয়া যায়। ১১ বছর পর রাজশাহীর পদ্মায় আমাদের তোলা গ্রে ফ্যালারোপ পাখির ছবিগুলো এই পাখির বাংলাদেশ অবস্থানের দ্বিতীয় সাক্ষ্য হিসেবে চিরকালের জন্য রয়ে গেল।’

দেশে প্রথমবার গ্রে ফ্যালারোপ পাখি শনাক্ত করা সীমান্ত দীপু জানান, তিনি বৈশাখ মাসে প্রথম ছবিটি তুলেছিলেন। এই সময়ই এগুলো দেখতে পাওয়া যায়। বোঝা যাচ্ছে, এরা নিয়মিত আসছে।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক প্রথম আলোকে বলেন, উপমহাদেশে এ পাখি দেখা যায়। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিরল পাখি। অল্প কয়েকটি আসে। এখন ওগুলোর চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে।