৯ মাস পর ‘সক্রিয়’ নজরুলকে কীভাবে দেখছে বর্তমান নেতৃত্ব

খুলনায় তারুণ্যের সমাবেশ সফল করতে লিফলেট বিতরণ ও সভা করছেন নজরুল ইসলাম। ফুলবাড়ি গেট, খুলনা, ১৫ জুলাই বিকেলে
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ৯ মাস পর বিএনপির হয়ে দলবল নিয়ে আবার মাঠে নেমেছেন খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম ওরফে মঞ্জু। খুলনায় ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ সামনে রেখে সপ্তাহখানেক ধরে নগরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন কর্মিসভা, প্রস্তুতি সভা, লিফলেট বিতরণ করছেন দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়া নজরুল ও তাঁর অনুসারীরা।

নজরুলের অনুসারীরা বলছেন, সরকার পতনে এক দফা আন্দোলন কর্মসূচিকে গতিশীল করতে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার তাগিদ থেকে মাঠে সক্রিয় হয়েছেন তাঁরা। তবে এভাবে মাঠে সক্রিয় হওয়াটাকে ভালো চোখে দেখছে না খুলনা বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব। বর্তমান নেতারা তাঁদের এই সক্রিয়তাকে ‘নেতা–কর্মী বা জনগণকে বিভ্রান্ত’ করার অপচেষ্টা বলে মনে করছেন।

দীর্ঘ ২৮ বছর খুলনা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন নজরুল ইসলাম। এর মধ্যে ১৬ বছর সাধারণ সম্পাদক ও ১২ বছর ছিলেন সভাপতি। খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্যও ছিলেন তিনি।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২২ অক্টোবর খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ হয়। সেখানে নজরুল ইসলাম, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানসহ বিএনপির সাবেক নেতারা বড় মিছিল নিয়ে যোগ দেন। তাঁদের মিছিলে মহানগর, পাঁচটি থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ওয়ার্ড কমিটির সাবেক নেতারা অংশ নেন। এরপর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং নিজেদের মতো করে দলের কিছু কর্মসূচি পালন করেছেন সাবেক নেতারা, তবে সরাসরি দলের কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। যদিও বর্তমান নেতৃত্বে থাকা বিএনপির নেতারা কোনো কর্মসূচিতেই তাঁদের আমন্ত্রণ জানাননি। কোনো পর্যায়ের কমিটিতেই নজরুলের অনুসারীদের রাখেনি বর্তমান নেতৃত্ব।

বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা যায়, কিছুদিন ধরে নজরুল ইসলাম ও তাঁর অনুসারীরা নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানায় সভা করছেন। কখনো সাবেক নেতার ব্যানারে, কখনো থানা বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানারে ওই সব সভা হচ্ছে। সেসব সভায় বড় জমায়েতও হচ্ছে।

খুলনা নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন একদফা আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন। সেটা সামনে নিয়েই তো বিভাগীয় তারুণ্যের সমাবেশ। আমরা রাজপথের কর্মী, আমাদের রক্তে–ঘামে খুলনা বিএনপি সংগঠিত হয়েছিল। আমরা বিএনপির বাইরে কিছু ভাবতে পারি না। খুলনার লাখো জনগণ আমাদের স্বীকৃতি দেয় বলে আমরা জনতার নেতৃত্ব। খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পদবঞ্চিত, পদহীন ও পদত্যাগী এবং সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথের সাহসী ত্যাগী নেতা-কর্মীদের তারুণ্যের সমাবেশ সফল করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

খুলনা বিএনপির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন কি না, তা জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তা পাইনি। তবে একদফা কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়েই সবাইকে দাওয়াত জানানো হয়েছে। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর আমরা সব সময় সক্রিয় আছি। যেহেতু আমাদের সমস্যার সমাধান হয়নি, আমরা দূর থেকে আমাদের মতো দলীয় কর্মসূচি করে যাচ্ছি।’

কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা আছে কি না, তা জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘গত সপ্তাহে মহাসচিব আমাদের জানিয়েছেন, খুলনার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন খুব শিগগির খুলনার সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবেন। সেই কথায় আস্থা রাখতে চাই। আমরা মনে করি, সামনে জোরালো আন্দোলন ও নির্বাচন। এ সময় ঐক্যবদ্ধ বিএনপি দরকার। মনে করি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করার পদক্ষেপ নেবেন। আমরা অপেক্ষায় আছি।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা নগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উনি (নজরুল ইসলাম মঞ্জু) বা ওনারা সাবেক নেতা বা এটা-সেটা ব্যানারে যাঁরা মিটিং করে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের মিটিং করার কোনো এখতিয়ার নেই। তাঁরা কোনো কমিটিতে নেই। তাঁরা না আছেন মহানগরে, না আছেন থানা বা ওয়ার্ডে। প্রতিটি জায়গায় আমাদের নির্বাচিত আহ্বায়ক কমিটি আছে। তাঁরা যে মিটিং করছেন, কী উদ্দেশ্যে করছেন, কী কারণে করছেন; সে বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল নই। তবে মনে করি, এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত একদফার যে আন্দোলনে আমরা আছি, এই আন্দোলনে নেতা–কর্মী বা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটা একটা অপচেষ্টা।’

২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর হঠাৎ কেন্দ্র থেকে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপির আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতির পদ থেকে নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে বাদ দেওয়া হয়। মহানগর বিএনপির নতুন আহ্বায়ক করা হয় আগের জেলা কমিটির সভাপতি শফিকুল আলমকে। আর জেলার আহ্বায়ক করা হয় আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমির এজাজ খানকে।

সে সময় নতুন ঘোষিত কমিটিতে নজরুল ইসলামকে বাদ দেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কমিটি ঘোষণার তিন দিন পর খুলনা প্রেসক্লাবে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। ওই সংবাদ সম্মেলনে খুলনা মহানগরের ৩১টি ওয়ার্ড কমিটির অধিকাংশেরই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। এরপর কেন্দ্র থেকে নজরুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময় তাঁকে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন থেকে মূলত রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা। ওই ঘটনার পর মহানগর বিএনপির সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, পাঁচটি থানার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার্ড কমিটির পাঁচ শতাধিক নেতা পদত্যাগ করেন।