‘ব্রহ্মপুত্র হামাক নিঃস্ব করি দিল’

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন থেকে রক্ষায় পাড় থেকে বসতবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন এলাকাবাসী। গত সোমবার বিকেলে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামেছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে প্রতিবছরই ভিটেমাটি হারাচ্ছেন হাজারো মানুষ। কোথাও নতুন চর জেগে উঠলেও আবার তা ভাঙনের কবলে পড়ছে। এতে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে অগণিত বসতি, স্কুল, মসজিদ, সেতুসহ অন্য অবকাঠামো ও ফসলি জমি। গত এক মাসের ভাঙনে শুধু সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে অন্যের জমি, বাঁধ কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। সেই সঙ্গে অন্য জেলা কিংবা শহরাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছেন অনেকেই।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের পূর্ব গোবিন্দপুর গ্রামে বসবাস করতেন শওকত আলী (৬০) ও ছলিমা বেগম (৫০) দম্পতি। ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনে ১০ বার ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের শিকার হয়েছেন তাঁরা। সম্প্রতি উজানের ঢলে নদের পানি বেড়ে ভাঙন শুরু হয়। তখন আবার সেখানকার বসতি হারান তাঁরা। বর্তমানে ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে পাঁচগাছি ইউনিয়নের চর পার্বতীপুর গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদের ভাঙনে ১৫ হাজার পরিবার নিজেদের বসতবাড়ি হারিয়েছে। চলতি বছর ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় ৪৪৭টি পরিবারের বসতভিটা ও ফসলি জমি নদে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া রৌমারী উপজেলার সোনাপুরে শতাধিক পরিবার বসতবাড়ি হারিয়েছে। অন্যদিকে রাজারহাট উপজেলায় তিস্তার ভাঙনে ৬৩টি পরিবার এবং ফুলবাড়ী উপজেলায় ধরলা নদীর ভাঙনে ৬টি পরিবার নিজেদের ভিটেমাটি হারিয়েছে।

ভাঙতে ভাঙতে এক ব্যক্তির আঙিনায় গিয়ে ঠেকেছে ব্রহ্মপুত্র। গত সোমবার কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

১৮ আগস্ট বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনের আগ্রাসী চিত্র দেখা গেছে। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর ভগবতীপুর এলাকার একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের পূর্ব গোবিন্দপুর এলাকায় প্রায় ৫০০ মিটার এলাকায় ভাঙন দেখা গেছে। গত ১৫ দিনে নদের ভাঙনে ওই এলাকার প্রায় ২৫টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। নদের ভাঙনের শিকার এসব পরিবার কেউ অন্যের বাড়িতে আবার কেউ আবাসন প্রকল্পের মাঠে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ওই এলাকায় দুটি মসজিদ, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র সেতুটি ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বসতবাড়ি নদে বিলীন হচ্ছে।

পূর্ব গোবিন্দপুর এলাকার আদম আলী (৬০) বলেন, তাঁর জীবনে কতবার যে নদ ভাঙল, এর কোনো হিসাব নেই। তবে ১৫ বার তো হবেই। এবার নদভাঙন শুরু হলে সবাই বাড়ি ভেঙে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। ২০ বছরের পুরোনো ভিটা রেখে যেতে মায়া তাঁর হচ্ছে। তাই এখনো তিনি কোথাও যাননি। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। ভাঙতে ভাঙতে ব্রহ্মপুত্র এখন তাঁর আঙিনায় ঠেকেছে।

নদভাঙনে ফসলি জমি, বসতবাড়ি চলে গেলেও সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ পাননি জানিয়ে পূর্ব গোবিন্দপুর গ্রামের ছলিমা বেগম বলেন, ‘কয়েক বিঘা জমি (ফসলি) থাকলেও এহন বাড়ি করনের জায়গাও নাই। ব্রহ্মপুত্র হামাক নিঃস্ব করি দিল।’

সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করার কথা জানিয়েছেন পাঁচগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল বাতেন সরকার। জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদের পাঁচটি পয়েন্টে ভাঙনঝুঁকি আছে। ইতিমধ্যে তিনটি পয়েন্টে নদভাঙন রোধে কাজ চলমান। পাঁচগাছি ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুটি পয়েন্টে দ্রুতই কাজ শুরু হবে।’