ছেলের জানাজায় বাবা বললেন, অনেক স্বপ্ন ছিল, দুর্ঘটনা সব কেড়ে নিল
ছেলের জানাজা পড়তে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এসেছেন। নামাজ শুরুর আগে প্রথা অনুযায়ী স্বনদের কাউকে বক্তব্য দিতে হয়। কিন্তু ছেলের জানাজায় কথা বলতে হবে, তা কি কখনো ভাবতে পেরেছেন সন্তানহারা বাবা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন? তাঁর কণ্ঠ দিয়ে যেন স্বর বের হচ্ছিল না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন। ক্ষমা চাইলেন ছেলের হয়ে। বললেন, ‘এই ছেলেকে নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা সব কেড়ে নিল।’
আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টায় নোয়াখালী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে দুর্ঘটনায় নিহত চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালের (চুয়েট) ছাত্র তৌফিক হোসাইনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। জানাজায় নোয়াখালী পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহিদ উল্যাহ খান, নিহত তৌফিকের সহপাঠীসহ শত শত মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
তৌফিক হোসাইনের মৃত্যুতে স্বজনদের শোকে ভারী হয়ে আছে নোয়াখালী পৌরসভার লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকা। বাড়িতে গেলেই মামার সানগ্লাস পরে ঘুরে বেড়াতেন তৌফিক। আর প্রতিবারই হারিয়ে ফেলতেন। এবার ঈদের আগে মামা তাই দুটো সানগ্লাস কিনেছিলেন। ঈদের পর চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় সেটা না নিয়েই চলে যান তৌফিক। মামাকে বলেন, ‘আগেরটা হারায়নি। পরে লাগলে নেব।’ মামা শরিফুল ইসলামের ঘরে দুটো সানগ্লাস এখনো পড়ে আছে। শুধু নেই আদরের ভাগনে।
‘তুমি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে! আমাকে মামা বলে কে ডাকবে এখন? আমার সানগ্লাসগুলো কে পরবে?’—ভাগনের মৃত্যুতে এভাবেই ক্রমাগত আহাজারি করছিলেন শরিফুল ইসলাম। পাড়া-প্রতিবেশী ও স্বজনদের অনেকেই তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই শরিফুলের কান্না থামছে না।
নোয়াখালী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের দোতলা বাড়িতে আজ আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড়। বাড়ি থেকে জানাজার তৌফিকের লাশ বের করার সময় স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ছেলের শোকে অনেকটা পাথর হয়ে গেছেন তৌফিকের মা তামিমা তারান্নুর। নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। স্কুলপড়ুয়া ছোট বোন ভাইয়ের জন্য কাঁদছেন অঝোরে।
তৌফিকের সঙ্গে স্কুল, কলেজে পড়া অনেক সহপাঠীই এসেছিলেন জানাজায়। তৌফিকের স্কুল (নোয়াখালী জিলা স্কুল) জীবনের সহপাঠী মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রোজার ঈদের কয়েক দিন আগে এক সঙ্গে জিলা স্কুল প্রাঙ্গণে ইফতার অনুষ্ঠান করেছেন তাঁরা। ঈদের পরের দিনও তৌফিকের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। মাত্র কয়েক দিনের মাথায় প্রিয় বন্ধুটি নেই—এটা বিশ্বাসই করতে পারছেন না কেউ।
উল্লেখ্য, গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে রাঙ্গুনিয়া থানার জিয়ানগরে মোটরসাইকেলে ঘুরতে বেরিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন চুয়েটের তিন শিক্ষার্থী। দ্রুতগতির শাহ আমানত পরিবহনের একটি বাসশিক্ষার্থীদের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে মারা যান চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শান্ত সাহা। তিনি নরসিংদী সদরের কাজল সাহার ছেলে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌফিক হোসাইন। এ ঘটনায় আহত হন চুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাকারিয়া হিমু। বর্তমানে তিনি নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।