লিবিয়ায় এক চক্র আরেক চক্রের কাছে বিক্রি করেছিল তাঁদের

লিবিয়ায় নিয়ে এ কক্ষে আটকে রাখা হয় আবদুল্লা আল জোবায়েরকেছবি: সংগৃহীত

দিনের পর দিন ছোট একটি কামরায় বন্দী রাখা, মারধর, দুর্ব্যবহার তো ছিলই, এসবের পাশাপাশি নানা কৌশলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা এনে দিতে চাপ দিত মানব পাচাকারীরা। এমনকি এক সময় তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয় আরেকটি পাচারকারী চক্রের হাতে। এসবের মধ্য থেকে বেঁচে ফিরবেন, ভাবেননি তাঁরা। লিবিয়ার দিনগুলোর কথা বলতে বলতে কষ্টে কান্না চাপছিলেন, কেঁপেও উঠছিলেন মাঝেমধ্যে।

মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর এলাকার মো. দিদারুল আলমের ছেলে আজমির হোসেন (২৪) ও উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ আজম নগর এলাকার যুবক আবদুল্লা আল জোবায়ের (২৪) প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরেছেন বলে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

গত বুধবার বিকেলে আবদুল্লা আল জোবায়েরের দক্ষিণ আজম নগর এলাকার বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল। সেখানে দুই তরুণের পরিবারের সদস্যরাই উপস্থিত ছিলেন। লিবিয়া–ফেরত দুই তরুণ এখনো শারীরিকভাবে দুর্বল। দুজনেরই ওজন কমেছে অনেকটুকু।

আজমিরের মা দেল আফরোজ বেগম দালালের কথায় আস্থা রেখে ছেলে আজমিরকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পাঠানোয় মত দিয়েছিলেন। দালাল বলেছিলেন, ইতালিতে বেতন পাবেন মোটা অঙ্কের। এ জন্য লাগবে অনেক টাকা। দেল আফরোজ তাই আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা ও ঘরের গরু বিক্রি করে দফায় দফায় দালালের হাতে টাকা তুলে দেন। কথা ছিল দুবাই, মিসর হয়ে ছেলেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দেবেন তাঁরা। সেখান থেকে ইতালি যাবেন তিনি। অথচ বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৪১ দিন পর লিবিয়ায় বন্দিদশা থেকে ন্যাড়া মাথায় কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন আজমির হোসেন। সেই সঙ্গে গেছে তাঁর ধারদেনার ছয় লাখ টাকাও।

এ ঘটনায় বাড়ি ফিরে আজমির হোসেন বাদী হয়ে সাহাদাত হোসেন, তাঁর ভাই আজাদ হোসেন, সজীব, আজিম, নুরুল করিম, বিবি জহুরাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা করেছেন।

আজমির হোসেন বলেন, লিবিয়াপ্রবাসী শাহাদাত হোসেন ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতে ইতালি নিয়ে যাওয়ার নানা প্রলোভন দেখাতে থাকেন তাঁর মাকে। সংসারের অভাবের কথা ভেবে মা দেল আফরোজ বেগম রাজি হন ছেলেকে ইতালি পাঠাতে। এ জন্য আগাম দেড় লাখ টাকাও নিয়ে যান সাহাদাত। বাকি টাকা আজমির নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যান। সাহাদাতের নির্দেশ অনুযায়ী কাগজপত্র জোগাড় করে গত ২১ মার্চ দুবাই পৌঁছান আজমির। বিমানবন্দরে সাহাদাতের লোকজন তাঁকে রিসিভ করে গাড়িতে তুলে ছোট একটা বাড়ির কক্ষে ৩০-৩৫ জনকে একসঙ্গে রাখেন।

সেখানে দুই দিন রেখে একটি ফ্লাইটে নিয়ে যান মিসর। মিসরে বিমানবন্দর এলাকায় গুদামঘরের মতো একটি স্থানে ২৪ ঘণ্টা রেখে আরেকটি বিমানে তুলে নিয়ে যান লিবিয়া। লিবিয়াতে পৌঁছার পরই বদলে যায় সাহাদাতের আচরণ। এখান থেকে ওখানে বারবার স্থান বদলায় তাঁর। চাকরি দেওয়ার কথা বললেই চলে মারধর। এদিকে বাড়িতে ফোন করে ধাপে ধাপে আদায় করে নেন ছয় লাখ টাকা।

আজমির হোসেন বলেন, ‘লিবিয়া পৌঁছানোর পরই আমাদের সবার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। বাড়ি থেকে ছয় লাখ টাকা আদায়ের পর সাহাদাত আমাকে চড়া দামে আরেক পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেন। এক দিন পর সেই পক্ষের হাতে তুলে দিতে লিবিয়ার একটি মরুভূমিতে ফেলে আসেন আমাকে। সেবার এক লিবীয় নাগরিকের সহায়তায় রক্ষা পেয়ে পরিচিত এক বাংলাদেশির আশ্রয় নিই। খবর পেয়ে সাহাদাত আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন।’

আজমির বলেন, পালানোর চেষ্টা করায় একটি কক্ষে আটকে রেখে নিয়মিত মারধর করা হতো তাঁকে। মারধরে অংশ নেয় সাহাদাতের ভাই আজাদ হোসেন, সজীব ও আজিমসহ আরও কয়েকজন। সেখানে আট দিন অনাহারে থাকার পর জানালার কাচ ভেঙে একদিন পালিয়ে যান আজমির। তবে সে যাত্রায়ও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। এরপর নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে গত ৫ মে ন্যাড়া মাথায় মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়ি আসেন তিনি।

নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিলেন আজমিরের মতোই আরেক যুবক আবদুল্লা আল জোবায়ের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের মহসীন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিরতি পড়ে আমার। সাহাদাতের ছোট ভাই চক্রের সদস্য আজাদ হোসেন আমার বন্ধু। ওর কথা বিশ্বাস করে এ পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমার বাবা কুয়েতপ্রবাসী। বারিয়ারহাটে আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। আমাকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়া নিয়ে যায়। আজিমের সঙ্গে যা হয়েছে তার সবকিছুই আমার সঙ্গেও হয়েছে। ওই চক্রের সদস্য অনেক। বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীরা তাঁদের টার্গেট। ভালো চাকরি বা ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে লিবিয়া নিয়ে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই হচ্ছে তাঁদের কাজ। আমার পরিবারের কাছ থেকে চার লাখ টাকা আদায় করেছেন তাঁরা। অনুরোধ করব, এই মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে আর কেউ যাতে লিবিয়া না যান। এ ঘটনায় আমি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতারণার শিকার আজমিরের মা দেল আফরোজ বেগম বলেন, ‘আমি শেষ হয়ে গেছি। ভালো চাকরির কথা বলে আমার ছেলেকে লিবিয়া নিয়ে অত্যাচার করে ওর জীবন শেষ করে দিয়েছে। আমার এখন ছয় লাখ টাকা দেনা। মাথায় আঘাত করায় ছেলে এখন মানসিক রোগী হয়ে গেছে। ছেলের শোকে ওর বাবা দুইবার ব্রেনস্ট্রোক করেছে। আমার পরিবার এলোমেলো করে দিয়েছে ওরা। আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আজাদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিবিয়াপ্রবাসী সাহাদাত হোসেন একই এলাকার আজমির হোসেনকে ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়ে প্রতারণা করেছেন। বিষয়টি আমি জানি। আজমিরকে দেশে ফেরাতে আমি ফোনে বেশ কয়েকবার সাহাদাতের সঙ্গে কথা বলেছি। ভিডিও কলে সেখানে মারধরে আজমিরের মাথা ফুলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। এ ঘটনায় আজমির বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেছেন।’

জানতে চাইলে আজিমের করা মামলাটির আইনজীবী অনিমেশ কুমার সোম প্রথম আলোকে বলেন, লিবিয়াতে প্রতারণা ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে মর্মে একটি ফোজদারি মামলা করেছে। বিজ্ঞ আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে সেটি তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে।