ভয়-আতঙ্ক কাটিয়ে ফসলের খেতে নেমেছেন ঘুমধুম সীমান্তের কৃষকেরা

কৃষক খাইরুল আমিনের পেছনে মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। এই ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে রোববার থেকে দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়। আজ বুধবার বিকেলে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের পশ্চিমকুল এলাকায়ছবি: এস এম হানিফ

১০০ মিটার দূরে মিয়ানমার সীমান্ত। এপারে ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত কয়েকজন কৃষক। চারা রোপণ করতে করতে খাইরুল আমিন (৪০) নামের একজন কৃষক বলেন, ‘গত রইবারত্তু (রোববার থেকে) খেতির পাশদ্দি আইত ন পারি। গত রাতিয়া ও আজিয়া দিনত গোলাগুলি ও মর্টারশেলের আওয়াজ ন ওনি (শুনিনি)। এতোল্লাই দুইজ্জ্যার পরত্তু (দুপুরের পর) চারা রুইবার হাজ গরির। আজিয়া হালিয়ার (আজকালের) মধ্যে চারা রুইত ন পারিলে পচি যাইতো।’

খাইরুল আমিন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের পূর্ব পশ্চিমকুলের বাসিন্দা। পশ্চিমকুল গ্রাম থেকে মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দেখা যায়। গত রোববার থেকে এই ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়।

আজ দুপুরে ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, পশ্চিমকুল, উত্তরপাড়া, হিন্দুপাড়া, কোনারপাড়া এলাকায় অনেক কৃষককে খেতে কাজ করতে দেখা গেছে। উত্তরপাড়া এলাকায় সবজি খেতে কাজ করছিলেন ছেনুয়ারা বেগম (৩৫)। খেতের আইলে বসে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার দুইজ্জ্যা (দপুরে) ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রত গেইলাম। আজিয়া দুইজ্জা আইস্সি। এহন সবজি খেতিত আগাছা পরিষ্কার গরির।’ ছেনুয়ারা বলেন, ‘গত রইবারত্তু (রোববার থেকে) সব সময় আতঙ্কত থাক্কিলাম। এলাকার বেশির ভাগ ঘরত গোলা আই পইজ্জে (পড়েছে)। মঙ্গলবার রাতিয়া গোলাগুলি হইম্মেদে (কমে যাওয়ায়) এতোল্লাই আতঙ্কও হইম্মে (কমেছে)।’

প্রায় এক মাস ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই চলছে। বাংলাদেশ সীমান্তের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে এত দিন লড়াই চললেও এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি। তবে গত শনিবার দিবাগত রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্তে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সংঘর্ষ তীব্র হয়। সেই সংঘর্ষ এখনো চলছে।

উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোলায়মান (৬৭) প্রথম আলোকে বলেন, স্ত্রী, চার ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে তাঁর সংসার। সবাইকে রামু পাঠিয়ে দিয়ে খেত-খামার ও গরু-ছাগল নিয়ে বসতবাড়িতে থেকে গেছেন তিনি। তাঁর কাছে এখনো সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। এ কারণে খাবারদাবারে কষ্ট হলেও পরিবারের সদস্যদের এখনো সেখানে রেখে দিয়েছেন।

কোনারপাড়ার মোহাম্মদ ইউনুছের বাড়ি আর সীমান্ত মাত্র ৩০-৩৫ মিটারের দূরত্ব। সীমান্তের কাঁটাতার ঘেঁষে তাঁর জমি আছে অন্তত এক একর। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর তিনিও বসতভিটা ছেড়ে উখিয়া চলে গিয়েছিলেন। আজ বিকেলে তিনি পরিবার নিয়ে ফিরে এসেছেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ইউনুছ বলেন, ‘খেতখামারে কাজ না করলে খাব কী? বাচ্চাদের পড়াশোনা ও জীবন-জীবিকা সবই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখন খেতের পরিচর্যা করছি।’

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় হাজারো কৃষক আছেন। তাঁদের জীবন-জীবিকা ধান ও সবজিখেতের ওপর নির্ভরশীল। সীমান্ত পরিস্থিতি একটু শান্ত হওয়ায় সবাই খেতে নেমে পড়েছেন।