লোহাগাড়া
বনের ছড়া থেকে বালু তুলে বিক্রি
বালু তোলায় পাহাড়ি ছড়ার অন্তত ৩০টি স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। ছড়ার পাশে থাকা পাহাড়গুলোরও একটি অংশ কেটে ফেলা হয়েছে।
সংরক্ষিত বনের একটি ছড়ার ১৪টি স্থানে বসানো হয়েছে বালু তোলার যন্ত্র। সেখানে কাজ করছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। কেউ ছড়া থেকে বালু তুলছেন, কেউ বালু স্তূপ করছেন, কেউ আবার বোঝাই করছেন ট্রাকে। ১৪ নভেম্বর এই চিত্র দেখা যায় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের লম্বাশিয়া এলাকার সংরক্ষিত বনের প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায়।
নির্বিচার বালু তোলায় পাহাড়ি ছড়াটির অন্তত ৩০টি স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। ছড়ার পাশে থাকা পাহাড়গুলোরও একটি অংশ কেটে ফেলা হয়েছে।
বন থেকে বৈধ বা অবৈধ কোনোভাবেই বালু তোলা যাবে না। এর প্রভাবে ভূমিধস এবং বনের গঠনে পরিবর্তন হয়। চলাচলের পথ পরিবর্তন হওয়ায় বন্য প্রাণী লোকালয়ে প্রবেশ করে মানুষের মুখোমুখি হতে শুরু করে। এতে পর্যায়ক্রমে এসব বন্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেতড়িৎ কুমার বল, অধ্যাপক, বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা প্রায় পাঁচ বছর ধরে সংরক্ষিত বনের বালু তুলে বিক্রি করে আসছেন। এতে এলাকার অন্তত চারটি পাহাড় ও সাতটি টিলা বিলীন হয়ে গেছে। প্রশাসন একাধিকবার অভিযান চালানোর পরও পাহাড় কাটা ও বালু তোলা বন্ধ হয়নি। বরং প্রশাসনের জব্দ করা বালু নিলামে বিক্রি করার কারণে ক্রেতারা বৈধ বালু নিয়ে যাওয়ার নামে অবৈধভাবে তুলে বালু পরিবহন করছেন।
লম্বাশিয়া পাহাড়ি এলাকাটির অবস্থান চুনতি ইউনিয়নের দক্ষিণ সাতগড় গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে চুনতি হাজী রাস্তার মাথা। সেখান থেকে চুনতি ইসহাক মিয়া সড়ক হয়ে চার কিলোমিটার পূর্বে যাওয়ার পর একটি গ্রামীণ কাঁচা সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই লম্বাশিয়া এলাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাঁচ বছর আগে এলাকাটিতে যখন পাহাড় কাটা শুরু হয়, তখন সেখানে মানুষের যাতায়াত খুব একটা ছিল না। পুরো এলাকাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। খ্যাঁকশিয়াল, শজারু, বন্য শূকর, বনমোরগ, ময়ূর, গুইসাপ, অজগর বিচরণ ছিল সেখানে। এশিয়ান হাতির প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত চুনতি অভয়ারণ্যের পাশে হওয়ায় সেটিতে বুনো হাতির দলও দেখা যেত। গত বছরের ২৭ নভেম্বর বালু তোলার কারণে ছড়ায় তৈরি হওয়া গর্তে পড়ে দেড় বছর বয়সী একটি হাতিশাবকের মৃত্যু হয়েছে।
১৪ নভেম্বর এলাকাটিতে যাওয়ার পথেই পাঁচ থেকে ছয়টি বালুবোঝাই ট্রাক চলাচল করতে দেখা যায়। সরেজমিনে গিয়েও চারটি ট্রাকে বালু বোঝাই করতে দেখা যায় শ্রমিকদের। শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ শিশু।
সরেজমিনে শ্রমিক ও স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে প্রথমে ছড়াটির গতিপথ পাহাড়ের পাদদেশের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বাঁধের পাশে বালু তোলার কারণে বড় গর্ত তৈরি হয় ছড়ায়। ওই গর্তে বাঁধটির পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে পাহাড়ের একটি অংশও ধসে পড়ে। তখন ধসে পড়া অংশের বালুও সংগ্রহ করেন শ্রমিকেরা। বালু তোলার সুবিধার্থে পাহাড়ের শক্ত মাটি শ্রমিকেরা কোদাল ও খুন্তি দিয়ে কেটে নেন।
বালু উত্তোলন যন্ত্রের পরিচালনায় নিয়োজিত কয়েকজন শ্রমিক জানান, আবু তাহের নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি তাঁদের বালু উত্তোলনে নিয়োজিত করেছেন। বালু কোথায় বিক্রি হয়, অনুমতি রয়েছে কি না, কিছুই তাঁদের জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আবু তাহের নামে যে ব্যক্তির নির্দেশে বালু তোলার অভিযোগ উঠেছে, তাঁর নামে বন আইনে মামলা রয়েছে অন্তত ৩২টি। এর আগেও একই এলাকায় বালু তোলার অভিযোগে তিনি ও তাঁর ছেলে মিনহাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে বন বিভাগ মামলা করেছিল। আবু তাহেরের পদ-পদবি না থাকলেও তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেন।
জানতে চাইলে বালু তোলার কথা স্বীকার করেন আবু তাহের। তিনি বলেন, ‘আমার নির্দেশে কিছু বালু তোলা হচ্ছে। এখন কী করতে পারি? আপনাদের সঙ্গে প্রয়োজনে এ বিষয়ে বসব।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, বনের ছড়া থেকে তোলা এসব বালু প্রতি ট্রাক ১৮০০–৩২০০ টাকায় বিক্রি হয়।
চুনতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বালু তোলার বিষয়টি একাধিকবার উপজেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির মাসিক সভায় বলেছেন। বালু পরিবহনের ট্রাক চলাচলের রাস্তাটি বন্ধ করা ছাড়া সংরক্ষিত বন রক্ষার আর কোনো উপায় নেই।
চুনতি রেঞ্জের সাতগড় বন বিট কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সম্প্রতি দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই সংরক্ষিত বনের ছড়া থেকে বালু তোলার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
জানতে চাইলে একই ধরনের মন্তব্য করেন লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইনামুল হাছান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যোগদান করেছি কয়েক দিন হলো। এখনো সব বিষয়ে অবগত নই। এ ব্যাপারে তথ্য নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বন থেকে বালু তোলার কারণে বড় ধরনের ভূমিধস, বন্য প্রাণীদের খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি নানা সমস্যা সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তড়িৎ কুমার বল। তিনি বলেন, ‘বন থেকে বৈধ বা অবৈধ কোনোভাবেই বালু তোলা যাবে না। এর প্রভাবে ভূমিধস এবং বনের গঠনে পরিবর্তন হয়। চলাচলের পথ পরিবর্তন হওয়ায় বন্য প্রাণী লোকালয়ে প্রবেশ করে মানুষের মুখোমুখি হতে শুরু করে। এতে পর্যায়ক্রমে এসব বন্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে।’
হুমকির মুখে ২০ হেক্টর বোরো আবাদ
লম্বাশিয়ার সাতগড় ছড়া নামের পাহাড়ি ছড়াটির ওপর আশপাশের ২০ হেক্টর জমির কৃষকেরা নির্ভরশীল। বিশেষ করে বোরো ধানের আবাদ পুরোপুরি এই ছড়ার সেচনির্ভর। বালু তোলার কারণে ছড়াটির গতিপথ পরিবর্তন ও পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরা বিপাকে পড়েছেন।
স্থানীয় চাষি মো. মিজান প্রথম আলোকে বলেন, ছড়াটিতে এখন পানিপ্রবাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পানি ছাড়া চাষাবাদ সম্ভব নয়। তিনিসহ কৃষকেরা স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সরোয়ার বলেন, ‘কৃষকদের অভিযোগ তদন্ত করতে ওই এলাকায় গিয়েছি। অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। বালু তোলার ফলে ছড়ায় বড় বড় গর্ত হওয়ায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এলাকাটি একটি মরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দিয়েছি। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’