২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দুর্যোগ প্রশমনে দেশে যুগোপযোগী উদ্যোগের ঘাটতি

  • বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এখনো অনেকটা ত্রাণকেন্দ্রিক।   

  • দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বস্তরে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত কর।

  • দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমন্বয় করা।

ঘুর্ণিঝড় থেকে রক্ষায় দ্বীপের বাসিন্দাদের নিরাপদে নিয়ে আসছেন স্বেচ্ছাসেবীরা
ফাইল ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় ওপরের দিকে আছে বাংলাদেশ। এর প্রভাবে দেশে প্রতিবছর নতুন নতুন দুর্যোগ আসছে এবং তীব্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দুর্যোগ প্রশমনে দেশে যুগোপযোগী উদ্যোগের ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভুক্তভোগীদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমতা আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তাঁরা। 

এমন বাস্তবতায় আজ আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালন করা হচ্ছে। এবার দেশে এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই করি, দুর্যোগ সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এখনো অনেকটা ত্রাণকেন্দ্রিক। দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের এই সংস্কৃতি এড়ানো প্রয়োজন এবং এই প্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও আর্থিক বৈষম্য দূর করে সমতা আনার মতো বিষয়গুলোর সন্নিবেশ করা প্রয়োজন। দুর্যোগ হ্রাস বা প্রশমনের জন্য সরকারের নীতিগুলো সমন্বয়; দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বস্তরে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত করা; দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমন্বয়; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর মাধ্যমে নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং নাগরিকদের আর্থিক সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগঝুঁকি প্রশমন করা সম্ভব।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূল শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্যোগ প্রশমন ও মোকাবিলার সঙ্গে অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সব ধরনের দুর্যোগেই দরিদ্ররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্য তাদের প্রশমন ও মোকাবিলা সক্ষমতা কম। ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভুক্তভোগীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নীতি প্রণয়ন এবং মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে সমতা আনার মধ্য দিয়েই দুর্যোগ প্রশমনের কাজটি নিশ্চিত করা সম্ভব।

দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে প্রশমনে। 

দুর্বোধ্য সংকেতব্যবস্থা

ঘূর্ণিঝড়–সংক্রান্ত আবহাওয়া বিভাগের প্রচারিত সংকেত নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে  মানুষের মধ্যে। এতে দুর্যোগে ঝুঁকি বেড়ে যায়। বরগুনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি জেলার বেশ কয়েকটি এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। 

সমুদ্রগামী জেলেদের কাছে রেডিও থাকলেও গভীর সমুদ্রে তা কাজ করে না। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বরগুনা জেলা  ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বললেন, পাথরঘাটা থেকে ৪০-৫০ মাইল গভীর সাগরে গেলেই জেলেদের রেডিও আর কাজ করে না। এমনকি মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করে না। ফলে প্রতিবছর বহু জেলে প্রাণ হারান।

একইভাবে দেশে কৃষক ও কৃষি সামনে রেখে কোনো আবহাওয়ার পূর্বভাস দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কখন বৃষ্টি হবে, কখন পানি বাড়বে—এগুলো কৃষক জানেন না৷ 

বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

ভূমিকম্প ও সুনামির সচেতনতা কম

ভূমিকম্প ও সুনামির ক্ষেত্রে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু উপকূলবাসীর মধ্যে এসব দুর্যোগ সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। তাঁদের বেশির ভাগ এমন দুর্যোগের ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কেও  সচেতন নন।

স্থানীয় দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত অংশের টেকটোনিক প্লেটের ফাটল বরাবর একটি ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামি প্রায় তিন ঘণ্টা পর উপকূলে আছড়ে পড়েছিল। ফাটলটি এখনো সক্রিয় আছে। ভূমিকম্প থেকে সুনামি সৃষ্টি হলে উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় তা প্রায় ৪ মিটার (১৩ ফুট) উচ্চতায় আঘাত হানতে পারে। তা হলে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

সিপিপি মুখ থুবড়ে পড়েছে

নানা সংকটে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে উপকূলীয় ১৩ জেলায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) কার্যক্রম।

সিপিপির ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, সিপিপির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুমোদিত পদ ২৩২টি। এর ১৪৮টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। এর মধ্যে ১৩টি জেলা নিয়ে গঠিত সাতটি অঞ্চলে উপপরিচালকের সাতটি পদ রয়েছে। এ ছাড়া ৪৩টি উপজেলায় সহকারী পরিচালকের ৪৩টি পদ থাকলেও ২৪টি পদ শূন্য। তৃণমূল পর্যায়ে আবহাওয়ার খবর আদান-প্রদানের জন্য মাঠপর্যায়ে ৪৮টি এইচএফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ও ১১২টি ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) ওয়্যারলেস থাকলেও ১৫টি এইচএফ ও ৭০টি ভিএইচএফ ওয়্যারলেস দীর্ঘদিন ধরে বিকল। ওয়্যারলেস অপারেটরদের অর্ধেকের বেশি পদ শূন্য।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ও সিপিপির পরিচালক (প্রশাসন) আহমাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সিপিপিকে সরকার শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এখনো যানবাহন, অবকাঠামো ও লোকবলসংকট আছে। 

দক্ষিণাঞ্চলে পরিবেশ ও দুর্যোগঝুঁকি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি  প্রতিষ্ঠান রিচ টু আনরিচডের (রান) প্রধান নির্বাহী রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর দেশি-বিদেশি সহায়তায় এই এলাকার দুর্যোগ প্রশমনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর যেসব প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, এখন তা আর নেই। কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। তা চলমান রাখা প্রয়োজন।