এক কেজি আম বেচে চাষি কত পান
বাজারে এখন নানা জাতের আম। ক্রেতারাও বেছে নিচ্ছেন নিজেদের পছন্দমতো। ক্রেতার পছন্দ ও দামের শীর্ষে আছে ব্যানানা ম্যাঙ্গো। এরপর আছে ক্ষীরশাপাতি, আম্রপালি ও ল্যাংড়া আম। এ বছর আমের বাজার মন্দা। এর মধ্যে যা একটু লাভ হচ্ছে, সেটা ব্যানানা ম্যাঙ্গো, ক্ষীরশাপাতি ও আম্রপালি বিক্রি করে।
এবার বাজারের কম দামি আমে পরিণত হয়ে গেছে লক্ষ্মণভোগ বা লখনা আম। এই আমে চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। রাজশাহীতে এটির চাষ সবচেয়ে বেশি হলেও দাম বেশ কম।
চাষিদের হিসাব অনুযায়ী, এক বিঘার একটি মাঝারি আকারের বাগানে সাধারণত ২ টন (দুই হাজার কেজি) আম হয়ে থাকে। এ হিসাব অনুযায়ী ১ কেজি আমের জন্য জমির ইজারামূল্য পড়ে ১৫ টাকা। সার ও কীটনাশকের খরচ বাবদ ৬ টাকা। পরিবহন ও প্যাকেজিং খরচ ৬ টাকা এবং গাছ থেকে আম পাড়ার খরচ পড়ে ৫ টাকা। সব মিলিয়ে ১ কেজি আমের পেছনে মোকামে পৌঁছানো পর্যন্ত মোট ৩২ টাকা খরচ হয়। ১ মণ (৪৮ কেজিতে মণ হিসাবে) আম ১ হাজার ৫৩৬ টাকার কমে বিক্রি করলে চাষিদের লোকসান গুনতে হয়। যেকোনো জাতের আমের পেছনেই কমবেশি এই খরচ হয়ে থাকে, কিন্তু একই দামে সব আম বিক্রি করা যায় না।
আমচাষিদের হিসাব অনুযায়ী, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার তাঁরা আমের দাম পাচ্ছেন কম। ১ কেজি আম থেকে ৩২ টাকার বেশি যা পান তা–ই কৃষকের লাভ। এর কম যা হচ্ছে, তার পুরোটাই লোকসান। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, কেজিপ্রতি আমের খরচ পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
কোন আমের কেমন দাম
ব্যানানা ম্যাঙ্গো: এবারের আমের বাজার অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে ব্যানানা ম্যাঙ্গো। কেজিপ্রতি পাইকারি বাজারে এই আমের দাম এখন ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। রাজশাহীতে এই ব্যানানা ম্যাঙ্গোর চাষ হয়েছে মাত্র ১২ হেক্টর জমিতে। এ আমের দাম বেশি বা কম হলে কৃষকের আয়ের ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না। তবে এটি বিক্রি করে চাষিদের লাভ হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৮ টাকা। রাজশাহীর বানেশ্বর খুচরা বাজারে চাষিরা ১ কেজি ব্যানানা ম্যাঙ্গোর দাম হাঁকছেন ১৭০ টাকা। গত শুক্রবার (২০ জুন) বানেশ্বর বাজার ঘুরে এমনটিই দেখা গেছে।
ক্ষীরশাপাতি: এখন বাজারে যে কয়েক জাতের আমের দাপট, তার মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে ক্ষীরশাপাতি। এ আম ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় চাষিরা গড়ে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা মণ হিসেবে বিক্রি করছেন। তবে রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে এর দাম মণপ্রতি ২ হাজার ৪০০ থেকে আরও একটু ওপরে বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে ক্ষীরশাপাতি চাষিদের কাছে এখনো লাভজনক একটি জাত। এটি বিক্রি করে চাষিদের লাভ হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৮ টাকা।
আম্রপালি: আম্রপালি এখন ক্ষীরশাপাতির মতো একই দামে বিক্রি হচ্ছে। এ আম কমবেশি ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি হিসাবে বিক্রি হচ্ছে, চাষিদের কাছে এখনো যা বেশ লাভজনক। ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হলে চাষি কেজিতে লাভ পাচ্ছেন ১৮ টাকা।
ল্যাংড়া: স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় ল্যাংড়া আম সব সময় ভালো দামে বিক্রি হলেও এবার এখন পর্যন্ত এই আম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। চাষিরা বলছেন, এ আম থেকে তাঁদের লোকসান হচ্ছে। ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হলে প্রতি কেজিতে চাষির লোকসান হচ্ছে ৩ টাকা। তা ছাড়া এর আবাদও বেশি নয়। জেলায় ১ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে ল্যাংড়া আমের চাষ হয়েছে।
ফজলি: রাজশাহীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী আম ফজলি। জেলায় এ আম চাষ হয়েছে ২ হাজার ৩৯০ হেক্টর জমিতে। এর দাম এবার কিছুতেই উঠছে না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার বাজারে ফজলি আমের দাম মণপ্রতি ৮০০ টাকা। এটি লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। চাষিদের হিসাবে কেজিপ্রতিতে ১৫ টাকা লোকসান হচ্ছে। রাজশাহীর বানেশ্বর বাজারে ফজলি আম শুক্রবার সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ দরে বিক্রি করতে পারলেও চাষিদের কেজিপ্রতি ৩ টাকা লোকসান হচ্ছে।
লক্ষ্মণভোগ বা লখনা: ভালো ফলনের কারণে একসময় রাজশাহীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল লক্ষ্মণভোগ বা লখনা জাতের আম। এখনো জেলায় এ আমের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে লখনা আমের চাষ হয়েছে। কিন্তু বাজারে এর দাম এখন সবচেয়ে কম। বিভিন্ন পাইকারি বাজারের চাষিরা বলছেন, লখনা আম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ আমেই চাষিদের লোকসান সবচেয়ে বেশি। ৬০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হলে লোকসান হচ্ছে কেজিতে সাড়ে ১৯ টাকা।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, আমের উৎপাদন খরচ এর উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে। এক কেজি আম উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত গড়ে খরচ পড়ে ২০ থেকে ২৫ টাকা। পুরোনো জাত ও বড় গাছ কেটে চাষিরা নতুন জাতের আমগাছ লাগাচ্ছেন। গতানুগতিক আমবাগান হয়তো কমে যাবে, কিন্তু রাজশাহীর মাটি ও জলবায়ু আম চাষের উপযোগী। আধুনিক বাগান হবে, চাষিরা ব্যবসাসফল আম চাষ করবেন।
যা বলছেন চাষিরা
চাষিরা বলছেন, লখনা জাতের আমগাছ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। স্থানীয় বিভিন্ন আচার কোম্পানি পানির দামে এই আম কিনে নিয়ে যায়। গাছ থেকে আম পেকে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। যে ব্যবসায়ী যে দাম বলছেন, সে দামেই এখন ছেড়ে দিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ জাতের আমগাছ কেটে ফেলার হিড়িক পড়ে গেছে। এত বেশি গাছ কাটা হচ্ছে যে বাজারে রীতিমতো আম কাঠের দাম পড়ে গেছে।
রাজশাহীর আমচাষি বাঘা উপজেলার সাদি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম বলেন, বাঘার আমচাষিরা এবার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। সাবির্কভাবে অন্য বছরের তুলনায় আমের বাজার এবার অর্ধেক।আ