চট্টগ্রামে হেলে পড়া ভবনের মালিককে বারবার সতর্ক করলেও ‘পাত্তা’ দেননি

গত শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম শহীদ তৈয়াবিয়া হাউজিং এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলার সময় হেলে পড়ে ৪ তলার এই ভবন। গতকাল বেলা ১১টায়ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরে পশ্চিম শহীদ নগরে শীতল ঝরনা খালের পাশে হেলে পড়া চারতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে নকশা অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করে। খালের পাড়ে ভবন করতে গেলে অন্তত ১২ ফুট জায়গা ছাড়তে হয়। কিন্তু খোরশেদ ম্যানশন নামের ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তা ছাড়েনি মালিকপক্ষ।

খালে প্রতিরোধ দেয়ালের কাজ শুরুর আগে মালিকপক্ষকে বারবার সতর্ক করা হয়। নির্মাণকাজের সুবিধার জন্য জায়গাও ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তার কিছুই কানে নেয়নি মালিকপক্ষ। শেষ পর্যন্ত কাজ শুরু হলে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় ভবনটি হেলে পড়ে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ভবনের অর্ধশত বাসিন্দা। ভবনটিতে মালিকপক্ষ ছাড়া সাতটি পরিবার ভাড়াটিয়া ছিল।

এই ভবনমালিকের গাফিলতিতে পাশের অন্তত আরও পাঁচটি ভবন ঝুঁকিতে পড়েছে। ভবনগুলোয় প্রায় ১০০টি পরিবার বসবাস করত বলে জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়। গতকাল রাতেই পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। প্রকল্পের এই পর্যায়ে নগরের শীতল ঝরনা খালে কাজ চলছে।

হেলে পড়া ভবনের জায়গার মালিক মোসাম্মৎ মিলি কাউছার। তাঁর স্বামী খোরশেদ আলম দীর্ঘদিন দুবাইয়ে ছিলেন। ২০১১ সালে দেশে ফিরে আসেন। প্রবাসজীবনের আয় দিয়ে ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ৮ শতক জায়গার ওপর চারতলা ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। খোরশেদ আলম স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভবনটির তিনতলায় থাকতেন। ভবন হেলে পড়ার পর তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্য এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম নগরের খালগুলোয় প্রতিরোধ দেয়ালের নির্মাণকাজ চলাকালে ভবন হেলে পড়ার এ ঘটনা প্রথম নয়। ২০১৮ সাল থেকে কাজ শুরুর পর এখন পর্যন্ত ছয়টি খালের পাশে অন্তত ১০টি ভবন হেলে পড়েছিল। এর মধ্যে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি নগরের ষোলোশহরে একটি চারতলা ভবন এবং ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর রাতে নগরের মাদারবাড়ি এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলাকালে খালের পাশের দুটি ভবন, একটি মন্দির ও একটি কাঁচা ঘর হেলে পড়েছিল।

নকশা না নিয়ে এবং নকশার শর্ত ভঙ্গ করে খালের পাড়ে ভবন নির্মাণ করার কারণে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেন প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত প্রকৌশলী ও সিডিএর কর্মকর্তারা। তবে ভবনমালিকদের গাফিলতির পাশাপাশি সিডিএর তদারকির ঘাটতিও বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, সিডিএ নকশা অনুমোদন দিয়ে দায় সারছে। নকশা অনুযায়ী ভবন হচ্ছে কি না, তা ঠিকভাবে তদারকি করছে না।

বারবার সতর্ক, পাত্তা দেননি মালিক

পশ্চিম শহীদ নগরের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় চার মাস আগে এই এলাকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল ঝরনা খালে নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণকাজের জন্য খালের ভেতর মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের কর্মকর্তারা জানান, নির্মাণকাজ শুরুর আগে খালের পাড়ের ভবনমালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করা হয়।

নির্মাণকাজের সুবিধার জন্য ভবনমালিকদের কিছু কিছু অংশ জায়গা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এই অনুরোধে সাড়া দিয়ে খালের পাড়ে থাকা তিনটি ভবনের একাংশ নিজেদের উদ্যোগে ভেঙে ফেলে মালিকপক্ষ।

একইভাবে খোরশেদ ম্যানশনের মালিক মোছাম্মৎ মিলি কাউছার ও তাঁর স্বামী মোহাম্মদ খোরশেদ আলমকেও একাধিকবার জায়গা ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কেননা তাঁদের চারতলা ভবনের পেছনের দেয়াল ও কলাম (পিলার) নির্মাণ করা হয়েছে একেবারে খালের পাড় ঘেঁষে। মালিকপক্ষকে বলা হয়েছে, নির্মাণকাজ শুরু হলে ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বারবার অনুরোধের পরেও তিনি জায়গা ছাড়তে রাজি হননি।

সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নির্মাণকাজ করার পরও ভবনটি হেলে পড়েছে জানিয়ে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সিডিএ থেকে নকশা নিলেও এই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়নি। যদি মালিকপক্ষ নকশা মেনে ভবন করত এবং নির্মাণকাজ চলার সময়ে ৫ থেকে ১০ ফুট জায়গা ছেড়ে দিত তাহলে ভবনটি কাত হয়ে যেত না। তিনি বলেন, নির্মাণকাজ চলাকালে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে, তা নিজের দায় বলে মালিকপক্ষ আগেই তাঁদের কাছে মুচলেকা দিয়েছ।

আজ রোববার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনে ও পেছনে নিরাপত্তার জন্য দড়ি দিয়ে ঘেরাও দেওয়া হয়েছে। খোরশেদ ম্যানশনের একটি অংশ হেলে পড়েছে পাশের ছয়তলা তাহেরীয়া নামের ভবনের ওপর। ভবনের পাশে পুলিশি প্রহরা ছিল। ভবনগুলোর বাসিন্দাদের গতকাল রাতেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ সময় ভবনের নিচতলার ভাড়াটিয়া গাড়িচালক মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, সন্ধ্যার আগমুহূর্তে বাসায় ছিলেন। হঠাৎ ধুম করে একটি শব্দ হয়। এরপর ভবনটি হেলে পড়ে। এক কাপড়ে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে আসেন। এখন ভাইয়ের বাসায় উঠেছেন। কিন্তু বাসা থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। এখন কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে এই ভয়ে বাসায়ও ঢুকছেন না।

তিনতলার ভাড়াটিয়া আমান উল্লাহের বড় ভাই মো. সোহেল বলেন, গ্রামের বাড়ি থেকে গত শুক্রবার তাঁর বাবা-মা ছোট ভাইয়ের বাসায় আসেন। দাদা-দাদিকে দেখতে তাঁরাও সন্তানদের নিয়ে ভাইয়ের বাসায় এসেছিলেন। সবাই অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ভবনমালিককে সতর্ক করা হলেও তিনি তা ভাড়াটিয়াদের কিছুই জানাননি। এমনকি বলেছেন কিছুই হবে না। মালিকের গাফিলতির কারণে ভবনটি হেলে পড়েছে। ভবনমালিক যদি আগেই ব্যবস্থা নিতেন তাহলে এই ঘটনা ঘটত না।

আজ সকালে ভবনের আশপাশে কোথাও মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে ভবনমালিক মিলি কাউছারের স্বামী খোরশেদ আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে দাবি করেন, তাঁরা সিডিএর অনুমোদন নিয়ে নকশা মেনে ভবন করেছেন। ভবন নির্মাণের জন্য খালের পাশে থাকা নিজের অন্তত ৫ ফুট জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য সেনাবাহিনী জায়গা চাইলেও তিনি তা দেননি। কোনো ধরনের ক্ষতি হলে তা নিজের দায়-দায়িত্ব বলেও মুচলেকা দিয়েছিলেন তাঁরা। তবে এভাবে হেলে পড়বে তা কল্পনায় ছিল না। এখন বড় ক্ষতি হয়ে গেল।

এদিকে ভবন হেলে পড়ার পর গতকাল রাতে সাত সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।

কমিটির প্রধান করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালককে। কমিটিতে সিডিএ, সিটি করপোরেশন, নগর পুলিশ, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও গণপূর্ত বিভাগের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ভবনটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নকশা অমান্য করে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনমালিককে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তিনি জায়গা ছাড়তে রাজি হননি।