চট্টগ্রামে বর্ষার শুরুতে ক্ষতবিক্ষত সড়ক

সড়ক সংস্কারে গত আট বছরে ছয়টি প্রকল্পের আওতায় অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই বিপুল অর্থের সুফল পাচ্ছেন না মানুষ।

কয়েক দিনের বৃষ্টিতে বেহাল হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম নগরের কিছু সড়ক। চলাচলে দুর্ঘটনার ঝুঁকির পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে চালক ও যাত্রীদের। গতকাল বিকেল চারটায় স্ট্র্যান্ড রোডের আনুমাঝির ঘাট এলাকায়ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের স্ট্র্যান্ড রোড। নগরের সদরঘাট থেকে শুরু হয়ে এই সড়ক মিলিত হয়েছে বারিক বিল্ডিং মোড়ে। দেড় কিলোমিটারের কম দৈর্ঘ্যের এই সড়কটি পণ্য পরিবহনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই সড়কের পাশেই রয়েছে কর্ণফুলী নদী। আর নদীতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছোট-বড় ২২টি ঘাট রয়েছে। এসব ঘাট থেকে লোহার স্ক্র্যাপ, ভোগ্যপণ্য ও সিমেন্টের ক্লিংকারসহ বিভিন্ন পণ্য খালাস করা হয়। আর এসব পণ্য গাড়ির মাধ্যমে স্ট্র্যান্ড রোড হয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যায়।

পণ্য পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের অবস্থা এখন বেহাল। সড়কজুড়ে ছোট-বড় খানাখন্দ। কিছু কিছু অংশে গর্তের আকার এমন বড় হয়েছে, তা দিয়ে গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। মাঝেমধ্যে গাড়ি উল্টে যায় গর্তগুলোতে পড়ে। সড়কের কোথাও কোথাও উঁচু-নিচু ঢেউয়ের আকৃতি নিয়েছে। প্রায় সময় লেগে থাকছে যানজট। অথচ চার বছর আগে প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে স্ট্র্যান্ড রোডটি সংস্কার করেছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কিন্তু সংস্কারের বছর দুয়েক পর থেকে সড়কটি ভাঙতে শুরু করে। এখন আবার আট কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

শুধু স্ট্র্যান্ড রোড নয়, চট্টগ্রাম নগরের অন্তত ৩০ থেকে ৩৫টি সড়ক এখন বেহাল। এর মধ্যে নগরের প্রধান সড়ক যেমন রয়েছে, তেমনি অলিগলির সড়কও রয়েছে। সরেজমিনে বেহাল সড়কের এই চিত্র দেখা গেছে। সড়কগুলো যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভাঙা সড়কের গাড়ি চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে যানজটের সমস্যায় ভুগছেন চালক ও যাত্রীরা। আবার কিছু কিছু সড়কের এমন খারাপ অবস্থা, তাতে হেঁটে চলাচল করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের তালিকা করে সিটি করপোরেশন। তবে এবার কী পরিমাণ সড়ক নষ্ট হয়েছে, তার তালিকা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সড়ক ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন, বছরের পর বছর ধরে সড়কগুলো ঠিকভাবে সংস্কার করা হয় না। মাঝেমধ্যে সংস্কার করা হলেও তা জোড়াতালির সংস্কার। বৃষ্টি কিংবা ভারী গাড়ি চলাচল করলে অল্প দিনের মধ্যে সড়কগুলো ভেঙে পুরোনো চেহারায় ফেরে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সড়ক ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেছেন, বছরের পর বছর ধরে সড়কগুলো ঠিকভাবে সংস্কার করা হয় না। মাঝেমধ্যে সংস্কার করা হলেও তা জোড়াতালির সংস্কার। বৃষ্টি কিংবা ভারী গাড়ি চলাচল করলে অল্প দিনের মধ্যে সড়কগুলো ভেঙে পুরোনো চেহারায় ফেরে। এই কারণে তাঁরা যাতায়াতে যেমন কষ্ট পাচ্ছেন, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নগরের সড়ক নিয়ে নগরবাসী প্রতিবছর ভোগান্তি পোহালেও রাস্তাঘাট সংস্কারে সিটি করপোরেশনের ব্যয়ও কম নয়। গত আট বছরে ছয়টি প্রকল্পের আওতায় অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এই বিপুল অর্থের সুফল পাচ্ছেন না মানুষ।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীদের দাবি, ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা এবং বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সড়ক বারবার নষ্ট হচ্ছে। তবে সড়কগুলো সংস্কারে নিয়মিত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে বেহাল

চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট কাঁচাবাজারের পাশ দিয়ে গেছে চান মিয়া সওদাগর সড়ক। ২০১৭ সালে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে বড় ধরনের সংস্কার করা হয়েছিল সাড়ে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সড়কটি। তবে এই সংস্কার বেশি দিন টেকেনি। দুই থেকে তিন বছর পর ভাঙতে শুরু করে। এর মধ্যে সড়কের পাশে মির্জা খালে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এরপর সড়কের অবস্থা আরও খারাপ হয়। এখনো তা ঠিক করা হয়নি। তবে গাড়ি চলাচলের জন্য এখন ইট দিয়ে কোনোরকম ঠিক করে দিচ্ছে সিটি করপোরেশন।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে সড়কটি ঘুরে দেখা যায়, ব্যস্ততম এই সড়ক দিয়ে টেম্পো, ভ্যান, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলাচল করছে। কিন্তু কোথাও পিচঢালাইয়ের (কার্পেটিং) চিহ্ন নেই। মাঝে মাঝে গর্ত। জমে রয়েছে কাদাপানি।

সড়কের কালারপুল এলাকার লেপ–তোশকের দোকানি মোহাম্মদ রুবেল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সাত-আট বছর ধরে সড়কের এমন দুরবস্থা। সিটি করপোরেশনের কেউ খোঁজখবর নেন না। ঠিকও করেন না। দোকানের সামনে কাদাপানি জমে আছে। গাড়ি গেলে তা ছিটকে পড়ে দোকানে রাখা মালামালে। এখন ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

নগরের পলিটেকনিক এলাকার আব্দুল হান্নান সড়ক এখন এমন বেহাল। গতকাল দুপুরে মডেল স্কুল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় দুই বাসিন্দা বলেন, বৃষ্টি না থাকলে কোনোরকম হাঁটা যায়। তবে বৃষ্টি হলে পানি জমে এমন অবস্থা হয়, সড়ক দিয়ে হাঁটার সুযোগও থাকে না।

নগরের প্রধান সড়কের একটি হাটহাজারী সড়ক। নগরের মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার অংশের প্রায় সবখানে খানাখন্দে ভরা। সবচেয়ে বেশি বেহাল বিবিরহাট, হামজারবাগ, আতুরার ডিপো, রৌফাবাদ, আমিন জুট মিল ও অক্সিজেন মোড়। এই সড়ক দিয়ে নগর থেকে উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি এবং খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে যাতায়াত করেন মানুষ।

অক্সিজেন মোড়ের মৌসুমি ফল বিক্রেতা জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই সড়কের মোড়ে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে ইট-বালু দিয়ে ভরাট করে দিয়ে যান। কিন্তু গাড়ি চললে তা আবার উঠে যায়। রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে ধুলাবালু উড়তে থাকে। এতে বেচাকেনাও ঠিকভাবে হয় না।

অক্সিজেন মোড় থেকে ২ নম্বর গেট পর্যন্ত অবস্থিত বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের দুই পাশে রয়েছে শিল্পকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। কিন্তু সড়কটির অবস্থাও বেহাল। বিশেষ করে ২ নম্বর গেটের বেবি সুপারমার্কেট এলাকায় উড়ালসড়কের নিচে, পলিটেকনিক মোড়, বায়েজিদ বোস্তামী মাজার এলাকায় খানাখন্দ রয়েছে।

নগরের পলিটেকনিক মোড় থেকে ঝাউতলা রেলক্রসিং পর্যন্ত আবদুল হান্নান সড়কের কিছু অংশ ছাড়া সব অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খুলশী কলোনি, কৃষি ফার্মের পাশে বড় বড় গর্ত। গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের ইট দিয়ে গর্তগুলো ভরাট করতে দেখা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা হামিদুল ইসলাম বলেন, সড়কের এই দুরবস্থা আজকের না। বৃষ্টির পর আরও খারাপ হয়েছে। এত বড় বড় গর্ত হয়েছে গাড়ি চালানো যায়নি। অথচ এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজারো গাড়ি চলাচল করে।

চট্টগ্রাম নগরের ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো না। যার কারণে সড়কগুলো অনেক সময় পানিতে ডুবে থাকে। এতে সড়ক নষ্ট হয়। তবে নির্মাণকাজে মানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার না করা, ঠিকাদারদের তদারকি না করার কারণে কাজগুলো হয় যাচ্ছেতাই। ফলে অল্প দিনেই সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়ে।
স্বপন কুমার পালিত, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সরেজমিনে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে নগরের ফকির মোহাম্মদ সড়ক, কবির আহমদ সওদাগর সড়ক, আকমল আলী সড়ক, প্রাণহরি দাস সড়ক, হালিশহর আবাসিক এলাকার একাধিক সড়ক, শুলকবহরের আবদুল হামিদ সড়ক, নূর আহমদ সড়ক, জুবিলী সড়ক, আমবাগান সড়ক, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক, প্রবর্তক মোড় থেকে ২ নম্বর গেট মোড়, সিডিএ অ্যাভিনিউ, কে বি আমান আলী সড়ক, ইশান মহাজন সড়কের অবস্থা বেহাল।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভারী বর্ষণের কারণে নগরের বেশ কিছু সড়কের অবস্থা খারাপ। সুয়ারেজ প্রকল্পের জন্য ওয়াসা এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সিডিএ বিভিন্ন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করছে। এসব কারণে কয়েকটি সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই মুহূর্তে বড় ধরনের সংস্কার করা যাচ্ছে না। আপাতত প্রাথমিকভাবে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করে সংস্কার করে দেওয়া হচ্ছে।

একটি সড়ক পরিকল্পিতভাবে করা হলে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বছর টিকে থাকার কথা বলে জানান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরের ড্রেনেজব্যবস্থা ভালো না। যার কারণে সড়কগুলো অনেক সময় পানিতে ডুবে থাকে। এতে সড়ক নষ্ট হয়। তবে নির্মাণকাজে মানসম্পন্ন উপকরণ ব্যবহার না করা, ঠিকাদারদের তদারকি না করার কারণে কাজগুলো হয় যাচ্ছেতাই। ফলে অল্প দিনেই সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়ে।