মা–বাবার আর্থিক অনটন ঘোচানো হলো না সাদিয়ার

দিনাজপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার ওরফে প্রীতি (বাঁয়ে) ও ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী নীপা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

টিনের ছাউনির জরাজীর্ণ কক্ষটিতে বর্ষা এলে ভোগান্তি অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। টিনের ফাঁক গলে নেমে আসে বৃষ্টির পানি। এই কক্ষেই ঘুম, খাওয়াদাওয়া ও পড়াশোনা চলত সাদিয়া আক্তার ওরফে প্রীতির। রুমের সঙ্গে লাগোয়া একটি বারান্দা। সেখানে একটি চৌকিতে সাদিয়ার মা–বাবার ঘুমানোর জায়গা এটি। সাদিয়ার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে তিনি ব্যাংকের চাকরি করবেন। মা–বাবার আর্থিক অভাব দূর করবেন। ছোট ভাইকে পড়ালেখা করাবেন। কিন্তু এসবের কিছুই আর তিনি করতে পারবেন না। পানিতে ডুবে না–ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি।

সাদিয়া আক্তার দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ি এলাকার সাদেক আলীর মেয়ে। তিনি দিনাজপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশনি করাতেন তিনি। বিকেলে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের কাজ শিখতেন। গতকাল বৃহস্পতিবার হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ক্যাম্পাসের এক অগ্রজ শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেন সাদিয়া। ওই ছাত্রী বেঁচে গেলেও বেঁচে ফিরতে পারেননি সাদিয়া আক্তার। আজ শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বাড়ির পাশের কবরস্থানে তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।

পুলিশের একটি বিশেষ সূত্র থেকে জানা গেছে, দিনাজপুর সরকারি কলেজে এসে ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নীপা আক্তারের সঙ্গে সাদিয়ার পরিচয় হয়। নীপা ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর এলাকার বাসিন্দা। অনুজ সাদিয়াকে স্নেহ করতেন নীপা। স্থানীয় একটি ছেলের সঙ্গে নীপার প্রেম ছিল। গতকাল সকালে সাদিয়াকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান ওই ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের পুকুরপাড়ের ঘাটে বসে তাঁরা আড্ডা দিচ্ছিলেন।

গতকাল একই সময়ে পুকুরপাড়ে অবস্থান করছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপু দুজন পুকুরপাড়ে একটু দূরত্বে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলেন। একটি ছেলে সিঁড়িতে বসা ছিল। একজন আপুর সঙ্গে (নীপা) ওই ছেলেটার ঝগড়া চলছিল। একপর্যায়ে ছেলেটা রাগারাগি করে সেখান থেকে চলে যায়। এরপর ওই আপুটা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে এবং পুকুরে পড়ে যায়। পুকুরে অনেক কচুরিপানা ও জংলা ছিল। গলা পর্যন্ত ডুবে গেলে তিনি ছটফট করতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন আপুও (সাদিয়া) পানিতে ঝাঁপ দেন।’

দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের পুকুর। এই পুকুরের পানিতে পড়েই মৃত্যু হয়েছে সাদিয়া আক্তার প্রীতির
ছবি: প্রথম আলো

ওই ছাত্রী আরও বলেন, ঘটনাটি দেখে তিনি পুকুরের সঙ্গে লাগোয়া মাঠে ডেকোরেশনের কাজ করা শ্রমিকদের ডেকে আনেন। পরে তাঁদের উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক সাদিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। এখনো আইসিইউতে চিকিৎসাধীন নীপা আক্তার।

আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়ি এলাকায় প্রীতির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িভর্তি স্বজনেরা আহাজারি করছেন। মা রানু বেগম মেয়ের বই–খাতা নিয়ে আহাজারি করছেন। তিনি বলেন, ‘কলেজে যাবার সময় মাত্র ২০ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল প্রীতি। কত কষ্ট করে পড়ালেখা করত আমার মেয়েটা। সেই মেয়েটা আমার চলে গেল।’ আর কথা বলতে পারেননি রানু বেগম। মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে বসেছিলেন বাবা মোস্তফা হোসেন।

সাদিয়া আক্তারকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি। আজ শুক্রবার সকালে দিনাজপুর শহরের বালুবাড়ি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ জিন্নাহ আল মামুন বলেন, ‘বিষয়টি প্রাথমিকভাবে তদন্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী দুজনের কথা শুনেছি। একজনকে বাঁচাতে গিয়ে অপরজনের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত না করার জন্য পরিবার থেকে আবেদন করা হয়েছিল। তাই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। আইসিইউতে থাকা অপর মেয়েটিও আশঙ্কামুক্ত। শুনেছি তাঁদের সঙ্গে একটি ছেলে ছিল। তবে এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’