উপকূলের সংগ্রামী নারী মনিরা বেগমের এই ঘর, এই সংসার

উপকূলের অসীম জীবনী শক্তির মানুষদের একজন মনিরা বেগম। ঘূর্ণিঝড়ে ঘর হারিয়ে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আছেন খোলা আকাশের নিচে। সবকিছু সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় তাঁর চোখে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বড় সন্ন্যাসী গ্রামেছবি: প্রথম আলো

ঘূর্ণিঝড়ের আগের দিনে দুই মেয়েকে বাবার বাড়িতে রেখে এসেছিলেন মনিরা বেগম। স্বামী শেখ শহিদুল আর ছোট ছেলে আরিয়ানকে নিয়ে রাতে নিজেদের ঘরেই ছিলেন তিনি। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস তীব্র হতে থাকে। দমকা বাতাসে তাঁর ঘর নড়ে উঠছিল। একপর্যায়ে গোয়ালের গরু ছেড়ে দিয়ে স্বামী-সন্তানকে নিয়ে তিনি রওনা হন নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে। এরপরের দুই রাত সেখানে কেটেছে তাঁদের। কেবল শুকনো খাবার খেয়েই দুটি দিন কাটিয়েছেন তাঁরা।

মনিরা বেগমের বাবার বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়নের ষাটগম্বুজ রেলস্টেশন এলাকায়। তবে তিনি থাকেন স্বামীর বাড়ি রামপাল উপজেলার মল্লিকেরবেড় ইউনিয়নের বড় সন্ন্যাসী গ্রামে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বড় সন্ন্যাসী গ্রামে মনিরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের ঘরটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। শুধু মেঝের মাটিটুকু আছে। ভিটের এক কোণে ছোট্ট রান্নার জায়গা। সেখানে চুলায় কী যেন রান্না করছিলেন মনিরা।

আরও পড়ুন

মনিরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই দিন হলো ভাত তো রানতে পারিনি। কাইলও (সোমবার) বৃষ্টি ছেল সারা দিন। সকালে ছেলেডা আমার দেওরের (স্বামীর ভাই) ছেলে সাথে যাইয়ে খালে দে কয়ডা পুঁটি মাছ ধইরে আনছে। কানতিছে, বায়না ধইরছে, তাই একট্টু ভাইছে (ভেজে) দিচ্ছি।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে তাঁর।

কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নেন মনিরা। উপকূলের মানুষ যে অসীম জীবনী শক্তির, হয়তো তা প্রমাণেই নিজেকে সামলে নেন এই নারী। তিনি বলেন, বাড়িতে কিছু নেই। সব ভিজে গেছে। ছোট যে ঘরটি ছিল, সেটা তো একেবারেই গেছে। মেয়ে বড় হয়েছে। এ অবস্থায় ওদের কী করে বাড়ি আনবেন তিনি? কোথায় থাকবে? ঘর ঠিক না হলে তো মেয়েদের বাড়িতেও আনতে পারছেন না।

আরও পড়ুন
ভাঙা ঘরের পাশে বসে দুই দিন পর রান্না করছেন মনিরা বেগম। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাগেরহাটে রামপাল উপজেলার বড় সন্ন্যাসী গ্রাম
ছবি: প্রথম আলো

মনিরা-শহিদুল দম্পতির তিন ছেলে–মেয়ে। সবচেয়ে ছোট ছেলে মো. আরিয়ানের বয়স পাঁচ বছর। এই ছেলেই ছিল সে রাতে তাঁদের সঙ্গে। গতকাল বড়ির উঠোনে ছোট্ট একটি শাবল দিয়ে গর্ত করছিল আরিয়ান। কথা বলতে গেলে চুপ করে থাকে সে। পাশে তখন ভেঙে যাওয়া ঘরের কাঠ সরাচ্ছিলেন আরিয়ানের বাবা শেখ শহিদুল। তিনি বলেন, ‘রাতে তো শেল্টারে গিছিলাম। সকালে (সোমবার) ওদের রেখে বাড়িতে এসে দেখি ঘর নেই। একদম মাটিতে পড়ে গেছে। এরপর সব এই বাইর করছি। বিছানা তোশকটা পর্যন্ত ভিজে গেছে। বাঁধের মধ্যি হওয়ায় এহানে পানি আসেনি। কিন্তু মাঠের পাশে হওয়ার বাতাসটা বেশি পাইছে এই ঘরে।’

আরও পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ঘরবাড়ি ও বড় বড় গাছপালার পাশাপাশি বাগেরহাটে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা কলা-পেঁপেসহ বিভিন্ন সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসাবে, জেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে।

বড় সন্ন্যাসী গ্রামে শহিদুলদের বাড়ির উল্টো পাশে কৃষক লিয়াকত গাজীর (৪১) কলার বাগান। সেখানে কয়েকটি গরুও পালেন তিনি। তাঁর ওই বাগানের অর্ধেকের বেশি গাছই ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, ফলন্ত গাছগুলো সব পড়ে গেছে। এই বাগানে প্রায় দুই হাজার গাছ আছে। হাজারের বেশি হবে ভেঙে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালে বিধ্বস্ত শহিদুল-মনিরাদের বসতঘর। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বড় সন্ন্যাসী গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

এই গ্রামের পর নদী পার হলে মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়ন। ঝড়ের রাতে জলোচ্ছ্বাসে এই পুরো এলাকাই চলে যায় পানির নিচে। এতে ভেসে গেছে এই এলাকার মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন মাছের ঘের। স্থানীয় বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন বললেন, লবণের কারণে এখানকার মাঠে ধান হয় না তেমন। মাছ চাষই প্রধান পেশা। এলাকার সব ঘের ভেসে গেছে।

মৎস্য বিভাগের হিসাবে, জেলায় অন্তত ৩৫ হাজার মাছের ঘের ভেসে গেছে। প্রশাসন বলছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জেলার প্রায় ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রশাসনের হিসাবমতে, জেলায় ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এখন পর্যন্ত জেলার শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটার ধানসাগর এলাকায় ঝড়ে গাছচাপায় এক নারীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।