পাহাড়, সমুদ্র, চা–বাগান—একসঙ্গে দেখা যায় যে উপজেলায়
পাহাড়ের কোলঘেঁষা ঝাউবন। একটু দূরে চোখ রাখলে দেখা যায় নীল সমুদ্রের ঢেউ। এর সঙ্গে রয়েছে চা–পাতায় ভরপুর সবুজ উপত্যকা। পাহাড়, সমুদ্র আর চা–বাগানের এ রূপের দেখা মিলে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়।
উপজেলাটির অবস্থান চট্টগ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে। শঙ্খ নদের তৈলারদ্বীপ সেতু পার হয়ে এতে প্রবেশ করতে হয়। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে ছুটে আসেন। এ উপজেলার পরেই পর্যটনের রাজধানী–খ্যাত কক্সবাজারের অবস্থান।
চা–বাগান
চট্টগ্রাম থেকে তৈলারদ্বীপ সেতু পার হয়ে এক কিলোমিটার ভেতরে যেতেই দেখা মিলবে উপজেলার চাঁনপুর বাজারের। এ বাজার থেকে হাতের বাঁয়ে রামপুর ডিসি সড়ক দিয়ে পুকুরিয়া চৌমুহনী গেলেই বেলগাঁও চা–বাগান। দক্ষিণ চট্টগ্রামের এটিই একমাত্র চা–বাগান। সপ্তাহজুড়েই এ বাগান দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
চা–বাগানটির মূল ফটকের কাছে যানবাহন রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এরপরই ভেতরে ঢুকতে পারেন দর্শনার্থীরা। বিস্তীর্ণ বাগানে চা–পাতা তোলা, চা–পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, চা–শ্রমিকের জীবনধারা, বাংলো—সবকিছুই ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে।
১৯৮৫ সালে ৬৪০ একর জমির ওপর চা–বাগানটি গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন এটির আয়তন ৮৩৩ একর। এ বছর বাগানটি থেকে চার লাখ কেজি চা–পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিনই বাগানে দর্শনার্থীরা আসেন।আবুল বাশার, ব্যবস্থাপক, বেলগাঁও চা–বাগান
১০ অক্টোবর চা–বাগানটিতে গিয়ে দেখা যায়, নিরিবিলি পরিবেশের এ বাগান দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে এসেছেন। তাঁদের কেউ ছবি তুলছেন, আবার কেউ চা–পাতা পরখ করে দেখছেন। জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থেকে ঘুরতে আসা সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এলাকায় চা–বাগান রয়েছে। এরপরও বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিতে পাঁচ বন্ধু ঘুরতে এসেছি। এখান থেকে সমুদ্রসৈকতেও যাবে। একসঙ্গে বহু কিছু দেখা হবে, এ আশায় বাঁশখালীতে ঘুরতে আসা।’
বেলগাঁও চা–বাগানের ব্যবস্থাপক আবুল বাশার বলেন, ১৯৮৫ সালে ৬৪০ একর জমির ওপর চা–বাগানটি গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন এটির আয়তন ৮৩৩ একর। এ বছর বাগানটি থেকে চার লাখ কেজি চা–পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিদিনই বাগানে দর্শনার্থীরা আসেন।
সৈকতে মুগ্ধ পর্যটক
বাঁশখালীর সমুদ্রসৈকত বালিয়াড়ি, বেড়িবাঁধ আর ঝাউবন দিয়ে সাজানো। এটিই কক্সবাজারের পর দেশের বৃহত্তম সৈকত। উপজেলার খানখানাবাদ থেকে বাহারচরা, ছনুয়া, গণ্ডামারা ও সরল ইউনিয়নের ৩৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ সৈকত বিস্তৃত।
আয়তনে বিশাল এ সৈকতকে পৃথক তিনটি নামে ডাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এর একটি কদমরসুল সৈকত। উপজেলার গুনাগরী খাসমহল থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে এর দেখা মেলে। এটি উপজেলার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন সৈকত হিসেবে পরিচিত। ঝাউবন কিংবা বালিয়াড়িতে বসে সূর্যাস্ত ও লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি দেখা এ সৈকতের মূল আকর্ষণ।
বন বিভাগ জানায়, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সৈকতটিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়। এর পর থেকে এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। পরে সেখানে অবকাশযাপনের জন্য একটি রিসোর্ট, কংক্রিটের ছাতা ও বৈঠকখানা নির্মাণ করে পর্যটন করপোরেশন। বর্তমানে রিসোর্টটি বন্ধ থাকলেও কংক্রিটের ছাতা ও বৈঠকখানায় বসে থাকা যায়।
বন বিভাগ জানায়, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সৈকতটিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়। এর পর থেকে এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। পরে সেখানে অবকাশযাপনের জন্য একটি রিসোর্ট, কংক্রিটের ছাতা ও বৈঠকখানা নির্মাণ করে পর্যটন করপোরেশন। বর্তমানে রিসোর্টটি বন্ধ থাকলেও কংক্রিটের ছাতা ও বৈঠকখানায় বসে থাকা যায়।
কদমরসুল সৈকত থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দক্ষিণে খানখানাবাদ সমুদ্রসৈকতের অবস্থান। এখানে চোখে পড়বে বেড়িবাঁধে সারি সারি দোলনা ও কংক্রিটের সিসি ব্লক। নিচের দিকে তাকালে এসব ব্লকে বসে আড্ডা দিতে মন চাইবে অনেকের। এসব ব্লক ধরে দক্ষিণ দিকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ঝাউবন দেখা যায়। ২০০৬ সালে এসব গাছ লাগিয়েছিল বন বিভাগ।
দর্শনার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় তৃতীয় সৈকতটির নাম বাহারছড়া। বাঁশখালীর প্রধান সড়কের কালীপুর ইউনিয়নের সালেহার বাপের পুল থেকে পশ্চিম দিকে বশিরুল্লাহ মিয়াজির বাজার হয়ে এ সৈকতে যেতে হয়। বেড়িবাঁধের সিসি ব্লক আর স্থানীয় কিছু ছোট দোকানের কারণে এ জায়গা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণের। বেড়িবাঁধে সূর্যাস্ত দেখার আয়োজন হিসেবে চেয়ার, টেবিল ও বড় ছাতা বসিয়ে রেখেছেন স্থানীয় দোকানিরা। এ ছাড়া মাঝারি ও ছোট সাইজের ঝাউগাছ দেখতেও সৈকতে অনেকে আসেন।
সৈকতের উত্তর পাশে এক কিলোমিটারজুড়ে বেড়িবাঁধে বসানো হয়েছে সিসি ব্লক। ওই ব্লকে বসে সমুদ্র দেখার পাশাপাশি সূর্যাস্ত উপভোগ করেন দর্শনার্থীরা। ওই এক কিলোমিটারজুড়ে সৈকতে দোকানিরা চেয়ার–টেবিল আর বড় ছাতা বসিয়েছেন। সেখানে খাওয়ার পাশাপাশি সময় আড্ডায় মেতে ওঠেন বিভিন্ন বয়সী লোকজন। বাহারছড়া সৈকতের দক্ষিণ দিকের আধা কিলোমিটার সৈকতে লাগানো হয়েছে ঝাউগাছ।
রয়েছে পাহাড়-ইকোপার্ক
উপজেলার প্রধান সড়কের পূর্ব দিকজুড়েই বিস্তৃত পাহাড়ি অঞ্চল। পুকুরিয়া, সাধনপুর, কালীপুর, বৈলছড়ি, জলদি, শীলকূপ, চাম্বল ও পুইছড়ি—এই আট ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলই পাহাড়ঘেরা। এর মধ্যে কালীপুর ইউনিয়নেই রয়েছে উপজেলার সর্বোচ্চ পাহাড়। সেই পাহাড়চূড়া থেকে শঙ্খ নদ আর গণ্ডামারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৃশ্য দেখা যায়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় এসেছে চাম্বল ইউনিয়নের ‘মিনি কাশ্মীর’। বাঁশখালীর প্রধান সড়ক থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার ভেতরে চাম্বলের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকা আম্বাঘোনা, ছিবাজিল্লা ঝিরি, গৌরাণিতা ঝিরি ও বন্বিতার ঝিরি—এ চার অঞ্চল ‘বাঁশখালীর মিনি কাশ্মীর’ নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে উত্তর চাম্বল হয়ে সিকদার দোকান পর্যন্ত রিকশায় এসে প্রায় ২০ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছানো যায় সেখানে।
এ ছাড়া উপজেলায় পাহাড়ের সৌন্দর্যের আরেক আকর্ষণ ‘বাঁশখালী ইকোপার্ক।’ শীলকূপ ইউনিয়নে ২০০৩ সালে পার্কটি করা হয়। প্রায় এক হাজার হেক্টর উঁচু-নিচু পাহাড়, লেকের স্বচ্ছ পানি আর ঘন বনাঞ্চলের এ পার্কেও আসছেন অনেকে। এতে প্রায় ৩১০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। বাঁশখালীর প্রধান সড়কের মনসুরিয়া বাজার থেকেই পার্কে যাওয়া যায়।
বাঁশখালীর বাসিন্দা ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আলমগীর মোহাম্মদ বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাঁশখালী বিচিত্র এলাকা। পর্যটন করপোরেশনের যথাযথ মনোযোগ পেলে বাঁশখালী হয়ে উঠবে পর্যটনশিল্পে এক নতুন সম্ভাবনার সংযোজন।