কক্সবাজারের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি

কক্সবাজারে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে সংবাদ সম্মেলন। গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজার প্রেসক্লাবেছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজার বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশে বিমানবাহিনীর নির্মাণাধীন ঘাঁটিতে হামলা, সংঘর্ষ ও এক তরুণের মৃত্যুর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে বিভিন্ন সংগঠন ও ওই তরুণের পরিবার। গতকাল সোমবার রাত থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও এলাকার মানুষ শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ, মানববন্ধন, মৌনমিছিল, সংবাদ সম্মেলন করছে। এদিকে সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আজ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি।

আজ দুপুরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন (কসউবি)। বেলা ১১টায় বিদ্যালয়ের মাঠে স্থাপিত শহীদ মিনারে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে মৌনমিছিলসহ জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেন কসউবির সদস্যরা। এরপর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করা হয়। প্রধান উপদেষ্টা বরাবরে পাঠানো এই স্মারকলিপিতে শিহাব কবিরের হত্যার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘গতকাল সোমবার সমিতি পাড়ার সংঘর্ষের ঘটনায় কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শিহাব কবির গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত এবং ব্যথিত। এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পেছনে কিছু সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কারণ রয়েছে।’

স্মারকলিপিতে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে শিহাব কবিরের হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত, নিহত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ এবং এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।

যেভাবে সংঘর্ষের ঘটনা

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সমিতিপাড়ার পাশে বিমানবাহিনীর একটি তল্লাশিচৌকিতে হেলমেট পরা নিয়ে কুতুবদিয়া পাড়ার জাহেদ হোসেন নামের এক তরুণের সঙ্গে কর্তব্যরত ব্যক্তিদের কথা-কাটাকাটির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে জাহেদকে আটক করে ব্যারাকে নেওয়া হলে জাহেদের আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিমানবাহিনীর নির্মাণাধীন ঘাঁটি ও সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। তাতে দুই পক্ষে সংঘর্ষ লেগে যায়। থেমে থেমে আধা ঘণ্টা ধরে চলা ওই পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। তাতে গুরুতর আহত হন শিহাব কবির। স্থানীয় লোকজন শিহাবকে উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘কক্সবাজারের সমিতিপাড়ার কিছু স্থানীয় দুর্বৃত্ত গতকাল বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। বিয়াম স্কুলের পাশে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তির মোটরসাইকেলের কাগজপত্র না থাকায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ঘাঁটির ভেতরে নেওয়া হয়। এ সময় সমিতিপাড়ার আনুমানিক দুই শতাধিকেরও বেশি স্থানীয় লোকজন ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলে বিমানবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের বাধা দেন।

পরবর্তী সময়ে স্থানীয় লোকজনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট এলাকায় বিমানবাহিনীর সদস্য ও সমিতিপাড়ার কতিপয় দুষ্কৃতকারী লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলে দুর্বৃত্তরা বিমানবাহিনীর সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। এ সময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন আহত হন, যার মধ্যে বিমানবাহিনীর ৪ জন সদস্য (১ জন অফিসার ও ৩ জন বিমানসেনা) আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং শিহাব কবির নাহিদ নামের এক যুবককে গুরুতর আহত অবস্থায় বিমানবাহিনীর গাড়িতে করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন।’

নিহত শিহাব কক্সবাজার পিটিআইয়ের সাবেক সুপার মো. নাছির উদ্দিনের ছেলে। মা আমেনা খাতুন কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে কয়েক বছর আগে অবসর গ্রহণ করেন। থাকেন সমিতিপাড়ায়। তাঁদের সংসারে চার মেয়ে এক ছেলে। একমাত্র ছেলে শিহাব ব্যবসার পাশাপাশি জেলা আদালতে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কর্মরত। সংসারে স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে তাঁর।

গুলিতে ছেলের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে শিহাবের মা আমেনা খাতুন বলেন, ইটপাটকেল নিক্ষেপের সময় ছেলে (শিহাব) ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি গুলি মাথায় এসে লাগে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। বাবা নাছির উদ্দিনও গুলিতে ছেলের মৃত্যু হয়েছে উল্লেখ করে ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।

কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন ও সমাবেশ। আজ সকালে
ছবি: প্রথম আলো

জানাজা, দাফন, সংবাদ সম্মেলন

গতকাল রাত ৯টায় শহরের কক্সবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিহত শিহাবের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শিহাব এই স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। জানাজায় ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা। এতে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমানসহ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

জানাজা শেষে মৌন মিছিল বরে করেন শিক্ষার্থীরা। রাতে সমিতিপাড়ায় দ্বিতীয় জানাজা এবং আজ সকাল ১০টায় গ্রামের বাড়িতে রামুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তৃতীয় জানাজা শেষে শিহাবের মরদেহ মণ্ডলপাড়ার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

শিহারকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় গভীর শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে নাগরিক সংগঠন কক্সবাজার কমিউনিটি অ্যালায়েন্স-নামের একটি বেসরকারি সংগঠন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তও দাবি করা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে।

পাশাপাশি এ ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবিতে গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সমিতি পাড়া সমাজ কমিটির নেতারা সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি সাগর উল ইসলাম, সমিতি পাড়ার বাসিন্দা ও বিএনপি নেতা ফোরকানুর রহমান, এজাজ উল্লাহ কুতুবী প্রমুখ।

সংবাদ সম্মেলন থেকে শিহাব হত্যার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে সমিতি পাড়ার লোকজনকে ‘দুর্বৃত্ত’ হিসেবে উপস্থাপন করার ঘটনায় নিন্দা জানানো হয়।

বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।