আন্তর্জাতিক নারী দিবস
সুই–সুতায় সচ্ছলতা এল জীবনে
কিছু নারী কঠোর পরিশ্রম করে শুধু নিজেরই নয়, অন্যের ভাগ্যও বদলে দিচ্ছেন। এমনই একজন নারী রংপুরের তারাগঞ্জের লাভলী রানী।
পঞ্চম শ্রেণিতে উঠে অভাবের কারণে বিদ্যালয় ছেড়েছিলেন। ১৪ বছর বয়সে বাধ্য হয়েছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। জোটেনি ঠিকমতো দুবেলার ভাত। কথায় কথায় স্বামী করতেন নির্যাতন। এরই মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন নিজে কিছু করার। একসময় স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেলে তিনি শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। আসে সাফল্য, অভাবের সংসারে আসে সচ্ছলতা। এই সংগ্রামী নারীর নাম লাভলী রানী।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের উত্তর ঘনিরামপুর কলেজপাড়া এলাকায় তাঁর বাড়ি। সেলাইয়ের কাজ করে নিজেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁর দেখানো পথেই অনেকেই স্বাবলম্বী। সেলাইয়ের কাজ করে বেশ কাটছে তাঁদের দিন। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য লাভলী জয়িতার পুরস্কার পেয়েছেন।
লাভলী রানী প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৮৪ সালে তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের বোয়ালপাড়া গ্রামের দরিদ্র একটি পরিবারে তাঁর জন্ম। চার ভাই–বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। ১৯৯৮ সালে বাবা বিশ্বম্ভর রায় কিশোরী মেয়েকে তুলে দেন উত্তর ঘনিরামপুর কলেজপাড়া গ্রামের সমর চন্দ্রের হাতে। স্বামীর বাড়িতে এসেও সুখী হননি লাভলী । প্রায় অনাহারে–অর্ধাহারে থাকতে হতো। কথায় কথায় স্বামী করতেন নির্যাতন। এরই মধ্যে কোলজুড়ে আসে দুই সন্তান। ছোট ছেলের বয়স যখন তিন মাস, স্বামী তাঁকে রেখে আরেকটি বিয়ে করেন। অথই সাগরে পড়েন লাভলী। অনেক ভেবেচিন্তে ঘর থেকে বের হন জীবিকার সন্ধানে।
লাভলী রানী একটি বেসরকারি সংস্থায় অফিস সহায়কের কাজ নেন। হাতে কিছু টাকা আসে। সেই টাকা দিয়ে একদিন কিনে আনেন ২টি ছাগল আর ১৫টি হাঁস-মুরগি। লাভলী ভরসা পান। মানুষ ঠকায়, কিন্তু হাঁস–মুরগি, গরু–ছাগল ঠকায় না। মুরগি ডিম পাড়ে, ছাগল বাচ্চা দেয়। লাভলীর মনে আরও কিছু করার স্বপ্ন জাগে। ২০১২ সালে তারাগঞ্জ পল্লী উন্নয়ন অফিসের অধীনে নেন হস্তশিল্পর ওপর প্রশিক্ষণ। তারাগঞ্জ বাজারে দোকান ভাড়া নিয়ে শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি লাভলীকে। ভালো আয় হওয়ায় বদলাতে থাকে সংসারের চেহারা। তাঁর উন্নতি দেখে প্রতিবেশী অন্য অনেক নারী সেলাইয়ের কাজ শিখতে উদ্বুদ্ধ হন। লাভলী তাঁদের শিখিয়ে দেন।
লাভলী সেলাইয়ের পাশাপাশি বিউটি পারলারের দোকান দিয়েছেন। বে-সরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অধীনেও গ্রামের দারিদ্র্য নারীদের দেন সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ। সম্মানী হিসেবে পান ৭ হাজার টাকা। সব মিলেয়ে তাঁর মাসে আয় ২০ হাজার টাকা। বড় মেয়ে শম্পা রানীকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে হিমেল রায় দশম শ্রেণিতে পড়ছে। বাড়িতে বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। তিনটি গাভি, হাঁস, মুরগি ও ছাগল আছে তাঁর।
গ্রামের মিনতি রানী বলেন, ‘লাভলী আপার কাছে সেলাই শিখে অলস সময় কাজে লাগিয়ে মাসে ১০–১২ হাজার টাকা কামাই করছি।’
ইকরচালী গ্রামের গৃহবধূ মোর্শেদা বেগম জানান, ৬ বছর আগে লাভলী রানীর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন সেলাইয়ে কাজ। এখন তাঁরও মাসে আয় ১০ হাজার টাকা।
উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নুরে কাওছার জাহান বলেন, লাভলী সেলাইয়ের কাজ করে নিজের ভাগ্য বদল করেছেন। তেমনি অন্য নারীদেরও এগিয়ে নিচ্ছেন।