মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ে গমের আবাদ সাধারণত ভালো হয়। এ জন্য কয়েক বছর ধরে জেলায় কৃষকদের নানাভাবে উৎসাহ ও প্রণোদনা দিয়ে আসছে কৃষি বিভাগ। এরপরও জেলায় ২০১৯ সাল থেকে চলতি মৌসুম পর্যন্ত গম আবাদের জমির পরিমাণ কমেছে ১৩ হাজার ৫৬৩ হেক্টর। কমেছে উৎপাদনও।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, ভালো বীজ ও শ্রমিকের সংকট এবং অন্য ফসলের তুলনায় ফলন ও লাভ কম হওয়ায় গম চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। পাশাপাশি গমের চেয়ে কম সেচ ও কম খরচে উৎপাদন বেশি হওয়ায় অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকেছেন তাঁরা।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সাহবাজপুর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গম চাষে অন্য সব ফসলের তুলনায় ফলন ও লাভ কম হচ্ছে। তাই গ্রামের অনেক কৃষক গম চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। বাকিরা সামান্য পরিমাণ জমিতে এ ফসল চাষ করছেন।
প্রণোদনা দিয়েও গমের আবাদ বাড়ানো যাচ্ছে না। কৃষকেরা লাভ বেশি পাওয়ায় অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকছেন।সঞ্জয় দেবনাথ, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, রানীশংকৈল
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, গম চাষে উৎসাহ বাড়াতে কয়েক বছর ধরে উঠান বৈঠক, ব্লক প্রদর্শনী, কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেওয়া হয়। চলতি বছর জেলার আট হাজার কৃষককে ২০ কেজি বীজ এবং ১০ কেজি করে সার দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালে জেলায় ৫০ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৮৯ মেট্রিক টন গম। পরের বছর ২০২০ সালে ৫০ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে গম চাষ করে ২ লাখ ৭ হাজার ৬৮৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। কিন্তু পরের বছর থেকে আবাদি জমি ও ফলন কমতে থাকে। ২০২১ সালে ৪৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে গম চাষ করে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৯৪ হাজার ১৮৪ মেট্রিক টন।
২০২২ সালে ৪৫ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৭১ মেট্রিক টন গম। আর চলতি মৌসুমে ৪৪ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০১ মেট্রিক টন গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৫৭ হেক্টর জমিতে। আর গম উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ১২৬ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের পর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত জেলায় গম আবাদের জমির পরিমাণ কমেছে ১৩ হাজার ৫৬৩ হেক্টর।
এর বিপরীতে গত বছর ৩৩ হাজার ৬০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হলেও এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার হেক্টরে। গত বছর জেলায় শর্ষে চাষ করা হয়েছিল ১৩ হাজার ৩৭৪ হেক্টর জমিতে। এ বছর বেড়ে শর্ষে আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, গমের চেয়ে ভুট্টা চাষে লাভ বেশি হওয়ায় জেলায় গম চাষ কমছে। গত বছর তেলবীজের দামও ভালো পেয়েছেন। তাই শর্ষে চাষের দিকেও ঝুঁকেছেন কৃষকেরা। এতে গমের চাষ কমে গেছে। এবার কৃষকদের হাইব্রিড জাতের গম দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে গমের ফলন বেশি হবে। আর এটা হলে আবার গম চাষে ফিরবেন কৃষকেরা।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পারিয়া এলাকার কৃষক খসিউর রহমান বছর দুয়েক আগেও পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো ধানের পাশাপাশি গম চাষ করতেন। এখন আর গমের আবাদ করেন না এই কৃষক। এর পরিবর্তে তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা ও বাকি দুই বিঘায় বোরো ধান চাষ করছেন। খসিউর রহমান বলেন, ‘বাড়িতে খাওয়ার জন্য এখনো গম চাষ করছি। পরের বছর থেকে ভাবছি সব জমিতেই ভুট্টা চাষ করব।’ একইভাবে ওই এলাকার কৃষক আকতার হোসেন, রইসুল আলম, রজনী রায়ও গম ছেড়ে ভুট্টা চাষ করেছেন।
সদর উপজেলার রুহিয়া এলাকার কৃষক আল আমিনও একসময় গমের আবাদ করতেন। তিন বছর ধরে তিনি সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য অল্প একটু জমিতে গম ও বাকি জমিতে ভুট্টার চাষ করছেন। আল আমিন বলেন, এক বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে গম চাষে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। আর উৎপাদিত গম বিক্রি করে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২১ হাজার টাকা পাওয়া যায়। একই পরিমাণ জমিতে ভুট্টা চাষ করে পাওয়া যায় ৩০ হাজার টাকা।
রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় এলাকার কৃষক সোহরাব আলী (৫৯) বলেন, সরকার গমবীজের কেজি ৫৮ টাকা নির্ধারণ করলেও ডিলারের কাছ থেকে সেই বীজ কিনতে হয়েছে ৮০ টাকায়। একদিকে লাভ কম, আবার অন্যদিকে ভোগান্তি বেশি। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর গ্রামের কৃষক নারায়ণ বর্মণ বলেন, ‘ইঁদুর, পাখি ও গরু-ছাগলে খেতে গমের ক্ষতি করে। গম কাটার সময়ও শ্রমিক পাওয়া যায় না। এসব কথা ভেবে প্রণোদনার বীজ-সার নিইনি এবার।’
রানীশংকৈল উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, উপজেলায় এবার ১ হাজার ৬০০ কৃষকের মাঝে ব্লাস্টপ্রতিরোধী গমবীজের পাশাপাশি সার বিতরণ করা হয়। গত বছর উপজেলায় ৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে গম চাষ করেন কৃষকেরা। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৫০ হেক্টরে।