নোয়াখালী শহরের বার্লিংটন মোড় এলাকায় গত বুধবার সকালে বাসায় ঢুকে মা ও এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়েকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আলতাফ হোসেন নামের সন্দেহভাজন একজনকে আটক করে স্থানীয় লোকজন পুলিশে দেন। পরের কয়েক ঘণ্টার মাথায় জেলার পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম সুধারাম থানা প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে হত্যার কারণ ও ঘটনার বর্ণনা দেন।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপারের দেওয়া ঘটনার বর্ণনা গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি অনেক উৎসুক লোকজন শুনেছেন। কেউ কেউ মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেছেন। অনেকে নিহত নারী ও তাঁর পরিবারকে খাটো করে নানা মন্তব্য জুড়ে দিয়ে ওই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন। এ নিয়ে তিন-চার দিন ধরে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
নিহত নারীর স্বামী ফজলে আজিম ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন দাবি করেছেন, আটক আলতাফ হোসেন সঠিক কথা বলেননি।
প্রসঙ্গত, পুলিশ আলতাফের কথার ভিত্তিতে হত্যার কারণ ও ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
ঘটনার পরপরই পুলিশের বক্তব্য এবং সেই বক্তব্য ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিহত নারীকে নিয়ে অবমাননাকর আলাপের বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে আইনজীবী, নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মীর সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, আটক ব্যক্তি নিজের দোষ আড়াল করতে একটা কাহিনি সাজিয়ে পুলিশকে বলেছেন। আর পুলিশও তা যাচাই-বাছাই না করে তাৎক্ষণিক বাহবা নেওয়ার জন্য পুরো বক্তব্য সবার কাছে প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই, এমন মৃত ব্যক্তিকে খাটো করা হয়েছে, তাঁর পরিবারকে অন্যদের কাছে ছোট করা হয়েছে, যা কোনোভাবে দায়িত্বশীল আচরণ নয়।
নোয়াখালী জেলা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী (অপরাধবিষয়ক মামলায় অভিজ্ঞ) মোল্লা হাবিবুর রছুল ওরফে মামুন বলেন, ‘যে কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে, এসপি সাহেব যেটা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন আটক ব্যক্তির বরাত দিয়ে, এটা একটা কাহিনি বলে মনে হচ্ছে। যদিও তিনি খুনি, কারণ ঘটনার পরপরই তিনি হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। তাঁর দেওয়া জবানি বানানো ও মিথ্যা-বানোয়াট কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছে। কারণ, একজন নারীর কথায় সামান্য কিছু টাকার লোভে তিনি দেশে আসবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
মোল্লা হাবিবুর রছুল বলেন, ‘কোনো ঘটনার তদন্তের শুরুতে যদি অপরাধ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়, শুধু সেই তথ্যকে সঠিক মনে করে বসে থাকলে হবে না। তাহলে আমাদের চোখ সেই বিষয়টিতেই আটকে থাকবে। অন্যদিকে চোখ ঘোরানোর সুযোগ থাকে না। এ ঘটনার ক্ষেত্রেও আটক ব্যক্তির বক্তব্য তাৎক্ষণিক সঠিক ধরে তা জনসম্মুখে তুলে ধরা ঠিক হয়নি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বিভাগকে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল।’
একই বিষয়ে নোয়াখালী পল্লী উন্নয়ন সংস্থা (এআরডিএস) প্রধান নির্বাহী ও মানবাধিকারকর্মী আবদুল আউয়াল বলেন, ‘এই যে ঘটনা ঘটল, এটি একটি ভয়াবহ ধরনের ঘটনা। এটার মনস্তাত্ত্বিক দিকটি খতিয়ে দেখা দরকার। আমাদের সমাজে কেন ঘটছে? আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে ভূমিকা, আমার মনে হয় না এ ধরনের প্রেস কনফারেন্স করা, একজন নারীকে অভিযুক্ত করা, যিনি মারা গেছেন; এটা কোনোভাবে ঠিক হয়নি।’
নোয়াখালীর নারী অধিকার জোটের সভাপতি লায়লা পারভীন বলেন, ‘আটক ব্যক্তি ওই বাড়িতে যাওয়ার সময় ছুরি নিয়ে গিয়েছিলেন, এতে বোঝা যায় ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। এখন আমাদের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি যদি আমাদের নারীদের এভাবে ছোট করে কথা বলেন...। এটা করে পুলিশ ওই পরিবারের চৌদ্দগোষ্ঠীর ক্ষতি করেছে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনা-সমালোচনা ও বিশিষ্টজনদের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে আজ শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তিনি বিষয়টি শোনার পর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার সকাল ১০টার দিকে শহরের বার্লিংটন মোড় এলাকায় বাসায় ঢুকে নুর নাহার বেগম (৪০) ও তাঁর এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ে ফাতেমা আজিম ওরফে প্রিয়ন্তীকে (১৭) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে নুর নাহার ঘটনাস্থলে মারা যান। আর তাঁর মেয়ে ফাতেমাকে নোয়াখালীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যার ঘটনায় ফজলে আজিম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। আটক আলতাফ হোসেনকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালতে আলতাফ মা ও মেয়েকে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।