দিনাজপুরের বিরলে পেঁয়াজবীজ উৎপাদনে সাফল্য

দিনাজপুরের বিরলের গোবিন্দপুর গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে পেঁয়াজবীজের খেত। প্রথম বছরেই পেঁয়াজবীজ বিক্রি করে দুই কৃষকের চার লাখ টাকা লাভ হয়েছে।

মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্ত রায়ের পেঁয়াজ বীজের খেত। সম্প্রতি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার গোবিন্দপুর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

দিগন্তজোড়া পেঁয়াজের খেত। এক বিঘা, দুই বিঘা নয়, ১১ বিঘা জমিতে পেঁয়াজবীজের খেত করা হয়েছে। দুই থেকে আড়াই ফুট লম্বা গাছের সবুজ কাণ্ডে গোলাকৃতির সাদা সাদা ফুল বাতাসে দুলছে। দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন কোনো শিল্পী সবুজ চাদরে সাদা রঙের ফুলের ছবি এঁকেছেন। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য দেখতে অনেকেই ছুটে আসছেন। বিশাল আয়তনের এই পেঁয়াজখেত দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধামইর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পেঁয়াজবীজের চোখজুড়ানো এই খেত মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্ত রায়ের। তিন বছর ধরে তাঁরা পেঁয়াজবীজসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্যের বীজ উৎপাদন করছেন। এর মধ্যেই এসব বীজ উৎপাদন করে তাঁরা লাভও করছেন। তাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই পেঁয়াজবীজ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

শুক্রবার ওই পেঁয়াজবীজের খেত ঘুরে দেখা যায়, ১৪ জন শ্রমিক খেতের পরিচর্যা করছেন। খেতের এক প্রান্তে ফসলের নিরাপত্তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে টংঘর। মিলন জানালেন, গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ছয় শতাধিক বেডে (প্রতিটির প্রস্থ ১২ ফুট) পেঁয়াজের কন্দ রোপণ করেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বীজ উত্তোলন করবেন। এবার সাড়ে পাঁচ একরে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে ১০-১৫ লাখ টাকা লাভের সম্ভাবনা দেখছেন তাঁরা।

যেভাবে শুরু

মিলনের বাবা মঞ্জুরুল ইসলাম একজন কৃষক। ধান-আলু-ভুট্টাসহ শাকসবজি আবাদ করেন। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে বর্গার টাকা পরিশোধ ও সংসার চালাতে তাঁর হিমশিম অবস্থা। মিলন জানান, তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। ২০২১ সালে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাঁর বাবাকে মসলাসহ উচ্চমূল্যের ফসল চাষের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য ডাকা হয়। বাবার পরিবর্তে অংশ নেন মিলন। সেখানে জানতে পারেন, পেঁয়াজবীজ উৎপাদনের আদ্যোপান্ত। অধিক পরিশ্রম হলেও পেঁয়াজবীজে মুনাফা বেশি। মিলন সিদ্ধান্ত ও চ্যালেঞ্জ নিতে দেরি করেননি। একদিকে ইউটিউব ঘাঁটতে শুরু করেন, অন্যদিকে কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।

একপর্যায়ে ইউটিউবে কৃষিবিষয়ক ভিডিও দেখতে দেখতে মিলন ফরিদপুর সদর উপজেলার কৃষক শাহিদা বেগমের খোঁজ পান। যিনি পেঁয়াজবীজ উৎপাদনে দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছেন। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেঁয়াজবীজ উৎপাদনের জন্য পুরস্কৃতও হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে মিলন ও কলোনী কান্ত ফরিদপুরে যান। সেখানেও প্রশিক্ষণ নেন। এলাকায় ফিরে এসে তাঁরা তাঁদের থাকা পাঁচটি গরু বিক্রি করেন। সেই টাকাসহ জমানো কিছু টাকা দিয়ে ২০২২ সালে শাহিদার কাছ থেকে ৬০ মণ পেঁয়াজের কন্দ নিয়ে আসেন। প্রথমবারই পাঁচ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে পেঁয়াজ লাগান। সেবার সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে বীজ পেয়েছেন ২২ মণ। প্রতি মণ বীজ ৩৬ হাজার টাকা দর হিসেবে প্রায় ৮ লাখ টাকার বীজ বিক্রি করেছিলেন। বীজ বিক্রির ক্ষেত্রেও তাঁরা শাহিদা বেগমের সহযোগিতা পেয়েছেন। প্রথমবারেই তাঁরা পেঁয়াজবীজ বিক্রি করে চার লাখ টাকা লাভ করেন।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দিনাজপুরে স্থানীয় ক্ষুদ্র পেঁয়াজচাষিরা সাধারণত বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানির বীজ কিনে চারা উৎপাদন করতেন। সেই চারা থেকে স্বল্প পরিসরে পেঁয়াজ উৎপাদন করতেন। দুই বছর ধরে মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্ত বৃহৎ পরিসরে প্রথমবারের মতো পেঁয়াজবীজ উৎপাদন করছেন। এতে কৃষকেরা তাঁদের কাছ থেকে সহজেই উন্নত মানের পেঁয়াজবীজ কিনতে পারছেন।

আমরা পুরো দেশে এই বীজ ছড়িয়ে দিতে চাই। প্রত্যেক কৃষক যদি অল্প জমিতে নিজেরাই পেঁয়াজ চাষাবাদ করেন, আমাদের ঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে।
কলোনী কান্ত রায়, কৃষক, বিরল, দিনাজপুর

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দিনাজপুর জেলায় এবার ২ হাজার ২২৬ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। গত অর্থবছরে জেলায় পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২৫ হাজার ১৫৬ মেট্রিক টন।

জানতে চাইলে বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম বলেন, দিনাজপুরসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায় পেঁয়াজবীজ উৎপাদনের প্লট নেই। উপযুক্ত মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেও এত দিন কেউ দিনাজপুরে পেঁয়াজ আবাদে আগ্রহী হননি। কারণ, খুব পরিশ্রম ও যত্ন করতে হয়। সময়ও লাগে বেশি। মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্ত যে পরিসরে শুরু করেছেন, তাঁদের উৎপাদিত বীজ দিয়ে জেলার সর্বনিম্ন ৫০০-৭০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ লাগানো সম্ভব। এবার শুধু বিরল উপজেলাতেই ৩৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। কৃষি বিভাগ তাঁদের সার-কীটনাশক ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

এবার পেঁয়াজবীজ বিক্রি করে অনেক লাভ হবে বলে আশা করছেন মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্ত। কারণ, তাঁরা শ্রমিক দিয়ে যথাযথভাবে পেঁয়াজবীজের খেতের পরিচর্যা করছেন। এবার পেঁয়াজের গাছে ফুল ভালো এসেছে। এতে উৎপাদন ভালো হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।

মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্ত জানান, জমি চাষ, বীজ, রোপণ খরচ, সার ও কীটনাশক, সেচ, নিড়ানি, বাঁশ-সুতলি ও জমি ভাড়া বাবদ এবার প্রতি বিঘায় খরচ দাঁড়াবে প্রায় দুই লাখ। আশা করছেন প্রতি বিঘায় ২০০ কেজি বীজ পাবেন। যদি প্রতি কেজি পেঁয়াজ সর্বনিম্ন দেড় হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারেন, তাতে প্রায় ৩৩ লাখ টাকার বীজ বিক্রি হবে। এতে তাঁদের প্রায় ১১ লাখ টাকা লাভ হবে।

কলোনী কান্ত বলেন, ‘আমাদের উৎপাদিত বীজের মান ভালো। নিজের উৎপাদিত বীজে চারা প্রস্তুত করে পরীক্ষামূলক ২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ লাগিয়েছি। আমরা পুরো দেশে এই বীজ ছড়িয়ে দিতে চাই। প্রত্যেক কৃষক যদি অল্প জমিতে নিজেরাই পেঁয়াজ চাষাবাদ করেন, আমাদের ঘাটতি অনেকটাই কমে আসবে।’

মিলন ইসলাম ও কলোনী কান্তের পেঁয়াজবীজের খেত দেখতে আসছেন অনেক কৃষক। কেউ কেউ আগাম পেঁয়াজবীজ কেনার কথা বলে রেখেছেন।

বিজোড়া ইউনিয়নের এরশাদ মোল্লা বলেন, ‘কৃষি অফিসারের কাছে শুনে এই পেঁয়াজবীজের খেত দেখতে এসেছি। আগামী দিনে পেঁয়াজ লাগানোর চিন্তাও করেছি। এ ক্ষেত্রে মিলন-কলোনীর কাছে পরামর্শও নিয়েছি।’