রিকশাচালক কবি মজেল উদ্দীন লিখেছেন ‘মাটির কাব্য’, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সুধীজনদের প্রসংশা
‘চৈত মাসিয়া রোদের রাগে শুকায় না মোর ভেজা কাপড়
কথার চোটে কাপড় শুকায় দিন বদলের তাজা খবর।’
আবৃত্তি শেষ করেই স্বরচিত কবিতার ব্যাখ্যা দেন মজেল উদ্দীন। তবুও বলতে থাকেন, ‘ভাইরে কষ্টের কথা কাউকে বলতে হয় না। এমনভাবে কথা শোনায় মনে হয় চৈত মাসের রোদে গায়ে থাকা ঘামে ভেজা কাপড়ও শুকায় যায়। মানুষ খালি কথা দেয়। দিন বদলের কথা; কিন্তু কেউ কথা রাখে না। কাকে বলব কষ্টের কথা। তাই মনে আসে যা, লিখে রাখি তা।’
পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা হলেই এভাবে কবিতা শোনান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা মজেল উদ্দীন (৫১)। পেশায় তিনি রিকশাচালক। বাড়ি দিনাজপুরের বালুয়াডাঙ্গা নতুনপাড়া এলাকায় পুনর্ভবা নদীর পাড়ে। শহরের বাসিন্দাদের কাছে তিনি পরিচিত কবি মজেল উদ্দীন নামে। পানদোকানি থেকে শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী—প্রায় সবাই চেনেন তাঁকে। শরীর কুলায় না দেখে বছর পাঁচেক আগে রিকশা চালানো বাদ দিয়ে মানুষের ফাইফরমাশ খেটে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
মজেলের ভাষ্যমতে, প্রায় ২৩ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে আছেন তিনি। যখন যা উপলব্ধি লিখে রাখেন সিগারেটের প্যাকেটে, কখনো চটা কাগজে। প্রায় এক হাজার কবিতা ও গান লিখেছেন। যার এক–তৃতীয়াংশই মুখস্থ তাঁর। তাঁর লেখা প্রতিটি কবিতা ২ লাইন থেকে ১০ লাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি মজেলের লেখাগুলো থেকে বাছাই করা ৭২টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ মাটির কাব্য। যা তাঁর দীর্ঘ বছরের সৃজনশীল চর্চার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রকাশ।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে দিনাজপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বইটির মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছে। অনুষ্ঠানে মজেল উপস্থিত ছিলেন। তাঁর কবিসত্তা নিয়ে গুণীজনদের আলোচনা শুনেছেন এবং আনন্দ পেয়েছেন, অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।
যৌথভাবে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দিনাজপুরের সাহিত্য সংগঠন উত্তর তরঙ্গ সাহিত্য পরিষদ ও জেলা প্রেসক্লাব। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি ও আইনজীবী মাজহারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জলিল আহমেদ, আযাদ কালাম, জেলা নাট্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান, প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বরূপ বকসী, শিক্ষক মেহেনাজ পারভীন, মাসুদ মুস্তাফিজ প্রমুখ। মাটির কাব্য প্রকাশ করেছে প্রিয় বাংলা প্রকাশন।
লেখালেখির এত বছর পরে এসে নিজের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করতে পেরে কবি মজেল উদ্দিনের আনন্দের সীমা নেই। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে মজেল যেন হারিয়ে যান অন্য ভুবনে। কথা বলতে গিয়ে তাঁর গলা ধরে আসে; চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতার বিষয়-বৈশিষ্ট্য, ছন্দ, উপমার কলাকৌশল নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হয়। হতবাক হয়ে শোনেন কবি মজেল উদ্দীন। আলোচকদের সমালোচনার সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেন নিজস্ব কবিতা ভাবনার বিষয়বস্তু।
কবি মজেল ও তাঁর মাটির কাব্য প্রসঙ্গে আলোচনাকালে মাজহারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘মানুষ অন্ধকারের ভেতরে থেকেও আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায় থাকেন। ব্যক্তিজীবনের চাওয়া–পাওয়াগুলো বেশির ভাগ সময়ই মেলে না। এই চাওয়া-পাওয়ার ফারাকটুকুর মধে৵ই অনেকে কলমের ডগায় স্বপ্ন আঁকেন। মজেল উদ্দীনের কবিতা রোজকার অলিগলি, নিজস্ব বোঝবুদ্ধির আওতায় ক্যাপচার করা। প্রতিটি কবিতায় তাঁর নিজস্ব গণ্ডির পাতা বিছিয়ে দেওয়া; অব্যক্ত কথা। তাঁর দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র ভাষ্য ও অনুভূতিগুলোই মাটির কাব্যর মোড়কে জড়ানো।’
দৈনন্দিন জীবন ও প্রকৃতির কাছে শেখার পাশপাশি জেলায় বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত সাহিত্যানুষ্ঠান, সাহিত্য নিয়ে ঘরোয়া আলোচনায় উপস্থিত থাকেন মজেল উদ্দীন। জেলার অনেক শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, সংগঠক তাঁর পাশে আছেন। মজেল উদ্দীন বলেন, ‘আনন্দ পাই বলে গান-কবিতা লিখি। বাকি জীবনেও লিখে যাব। তবে আমি দর্শক সারির মানুষ। মঞ্চে গুণীজনদের সঙ্গে বসে খানিকটা অবাকই হয়েছি।’