সুনামগঞ্জ হাওর, পাহাড় ও নদীর অপরূপ মেলবন্ধন

টাঙ্গুয়ার হাওরের ঢেউয়ের খেলা, সারি সারি হিজল ও করচগাছ এবং পাখির ওড়াউড়ি পর্যটকের মন ভরিয়ে দেয়।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন টাঙ্গুয়ার হাওরে আসেন পর্যটকেরা। সারা দিন হাওরে ঘোরেন। আবার অনেকেই হাউস বোটে রাত যাপন করেন। সম্প্রতি হাওরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’। জেলার এই পরিচিতির মূলে আছে টাঙ্গুয়ার হাওর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকের কাছে অতিপ্রিয় স্থান। হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া ভারতের মেঘালয় পাহাড়। পাশেই বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দন শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী), সবুজ বনের বারিক টিলা, মায়াময় শিমুলবাগান আর ‘রূপের নদী’ জাদুকাটা।

সেখানে হাওর, পাহাড়, নদীর এক অপরূপ মেলবন্ধন রয়েছে। বিকেলের সোনারোদে মেঘের ছায়া পড়ে নীল হয়ে ওঠে বিশাল-বিস্তৃর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওরের জল। সেই জলে মৃদুমন্দ ঢেউয়ের খেলা, জলের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি সবুজ হিজল ও করচগাছ এবং পাখির ওড়াউড়ি পর্যটকের মন ভরিয়ে দেয়। তখন পুরো এলাকাকে ছবির মতো মনে হয়।

জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে এই হাওরের অবস্থান। ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর আয়তনের এই হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল, বিল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় সায়রে। ভরা বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওরের অপার সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবেই।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরে বেড়াতে এখন বেশ ভালো সুযোগ-সুবিধা রয়েছে পর্যটকদের জন্য। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ এখানে রয়েছে শতাধিক হাউসবোট। বর্ষা মৌসুমে পর্যটকেরা হাউসবোট নিয়ে হাওরে ঘুরে বেড়ান। রাতে থাকেন বোটেই। জ্যোৎস্না রাতে নৌকায় নেচ–গেয়ে আনন্দ করেন পর্যটকেরা। আবার ইচ্ছা করলে সকালে গিয়ে সারা দিন ঘুরে সন্ধ্যা নামার আগেই ফেরা যায় জেলা শহরে। কিছু কিছু হাউসবোট তাহিরপুর থেকে, আবার অনেক বোট আছে সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে পর্যটক নিয়ে হাওরে যায়। এসব হাউসবোটের সঙ্গে জীবিকা জড়িয়ে আছে প্রায় দুই হাজার পরিবারের। এসব পরিবারের কেউ মাঝি, কেউ পাচক, কেউবা ছোট নৌকায় করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেন নানা পণ্য।

জেলা প্রশাসনও টাঙ্গুয়ার হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের বিকাশে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা, হাউসবোট পরিচালনা, পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ নানা বিষয় চিন্তায় রেখে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। হাওরের উত্তর পাড়ের যেখানে রাতে হাউসবোটগুলো পর্যটকদের নিয়ে অবস্থান করে, সেখানে একটি খোলা মঞ্চ, ওয়াশব্লক, শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা, পর্যটকদের জন্য বসার বেঞ্চ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে এখানে রিসোর্ট তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে।

হাওরের পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য জেলাজুড়ে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। যেগুলো ঘুরে মুগ্ধতায় মন ও নয়ন জুড়ায় পর্যটকদের। মরমি সাধক হাসন রাজা, বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমসহ অসংখ্য বাউল-কবিদের জন্ম এই জেলায়। তাঁদের সহজিয়া জীবন, মনমাতানো গানও মানুষকে টানে সুনামগঞ্জে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাওরে পরিবেশবান্ধব পর্যটন বিকাশে নতুন কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। তবে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য আমাদের কাছে আগে। এখানে এখন পর্যটক আসেন। আমরা কিছু নীতিমালা করেছি। এগুলো সবাইকে মানতে হবে।’

লোকজ ট্যুরিজম স্থান হিসেবে ঘুরে দেখা যায়, জেলা শহরে থাকা মরমি সাধক হাসন রাজার সমাধি ও হাসন রাজা মিউজিয়াম, দিরাই উপজেলায় বাউল¤সম্রাট শাহ আবদুল করিমের সমাধি ও জাদুঘর; জগন্নাথপুর উপজেলায় লোককবি রাধারমণ দত্তের সমাধি। ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে দোয়ারাবাজার উপজেলায় বাঁশতলা (হকনগর) শহীদ স্মৃতিসৌধ, সদর উপজেলায় ডলুরা স্মৃতিসৌধ; শিল্পবিষয়ক পর্যটন স্থানের মধ্যে দেশের প্রথম স্থাপিত রাষ্ট্রায়ত্ত ছাতক সিমেন্ট কারখানা, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিছাখলী রাবার ড্যাম; ধর্মীয় পর্যটন স্থান হিসেবে পাগলা বড় মসজিদ, পণতীর্থ ধাম, আছিম শাহের মাজার, সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী নারায়ণতলা মিশন এলাকা। সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী ডলুরা এলাকায় গেলে পাশেই রয়েছে সীমান্ত হাট। ডলুরা স্মৃতিসৌধ এলাকায় পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে।