গাজীপুরের টঙ্গীতে শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলামকে হত্যার পর দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন নিহতের ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রী কাজলী আক্তার। সর্বশেষ গত রোববার মৃত্যুর আগে স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা বলেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিকে হারিয়ে তাঁর ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
শহিদুল গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের মিটালু গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের গাজীপুর শাখার সভাপতি ও রাজাবাড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ২৫ জুন রাতে টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকায় দুর্বৃত্তের হামলায় তিনি নিহত হন।
মিটালু গ্রামের পাকা রাস্তা থেকে আধা কিলোমিটার হেঁটে গেলে শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি টিলার ওপর শহিদুলের বাড়ি। আজ মঙ্গলবার বিকেলে বাড়িতে স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের ভিড় দেখা যায়। শহিদুলের থাকার ঘরের সামনে বসে কাঁদছিলেন তাঁর স্ত্রী কাজলী আক্তার। হাতে স্বামীর ছবি। শোকে মুহ্যমান পুরো পরিবার। কাজলী ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রায় অসাড় শরীর। দুই সন্তান সাদিকুল ইসলাম (১৯) ও ইব্রাহিম খলিল (৬) মায়ের পাশে বসে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
কাজলী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববার সন্ধ্যায় স্বামীর সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ কথা হয়। ঈদের কেনাকাটা নিয়ে কথা বলেন। তখন স্বামী জানিয়েছিলেন, সোমবার সবার জন্য কেনাকাটা করবেন। কিন্তু ওই দিন রাত ১১টার দিকে একজন ফোন দিয়ে জানান, তাঁর স্বামী গুরুতর অসুস্থ। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, তাঁর কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার ক্যানসার। আল্লাহ তারে না নিয়া আমারে নিয়া যাইত। তারে হারাইয়া এখন তো আমাদের সবার মইরা যাওয়ার অবস্থা। আমরা অসহায় হয়ে গেলাম।’
কাজলী আক্তার জানান, স্বামীর আয়ে পুরো পরিবার চলত। ভিটেমাটি ছাড়া কোনো আয়ের উৎস নেই। আড়াই মাস আগে তাঁর হঠাৎ জরায়ু ক্যানসার ধরা পড়ে। স্বামী তাঁকে রাজধানীর আহছানিয়া মিশন হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন। তিনবার কেমোথেরাপি দিয়েছেন। এখনো দুটি বাকি। এ ছাড়া ২৫টি রেডিয়েশন থেরাপি দিতে হবে। বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায়। ছোট ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কীভাবে, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আলমগীর হোসেন বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে চাকরি করেছেন শহিদুল। শান্তশিষ্ট হলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন তিনি। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে ফেডারেশনে যোগ দেন। ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাসসহ নানা বিষয়ে প্রতিবাদ করায় তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর এমন মৃত্যু এলাকাবাসী মানতে পারছেন না।
শহিদুলের ছোট ছেলে ইব্রাহিম বাবার মৃত্যুর বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে না পারলেও বড় ছেলে সাদিকুল বাবার কথা মনে করে বারবার কাঁদছিলেন। এক দিন পরেই বাবার সঙ্গে দুই ভাইয়ের ঈদ করার কথা ছিল। সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাবাকে হারিয়ে আমাদের যেন সব হারিয়ে গেছে। আমার মায়ের চিকিৎসা নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়ে গেছি। বাবাকে হারিয়েছি। মাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতেই হবে।’
২৫ জুন টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ি এলাকায় বেতন-বোনাস নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। এ বিষয়ে কারখানার মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে শহিদুল কারখানা থেকে বের হতেই হঠাৎ দুর্বৃত্তরা অতর্কিত হামলা চালান। তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা সাতজনকে আসামি করে টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। মামলার এক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।