দিনের বেশির ভাগ সময় ছেলের কবরের পাশে কাটান ওয়াসিমের বাবা

চট্টগ্রামে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরামছবি: পরিবার থেকে নেওয়া

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরামের পরিবার এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাবা শফিউল আলম ছেলের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে সৌদি আরব থেকে দেশে চলে আসেন। এর পর থেকে প্রতিদিনই ছেলের কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। দিনের বেশির ভাগ সময় সেখানেই কাটে তাঁর।

ওয়াসিম নেই—মা জ্যোৎস্না বেগম এখনো বিশ্বাস করতে চান না। প্রতিটি ক্ষণে তিনি ওয়াসিমের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। ছেলের সব স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভাসে।

মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরাম ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে নিহত হন। তাঁর বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজার পাড়া এলাকায়। তিনি চট্টগ্রাম কলেজে স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষে পড়তেন। চট্টগ্রাম কলেজ ও পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ওয়াসিম পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। বড় ভাই আরশেদ আলী সৌদিপ্রবাসী (বর্তমানে দেশে), বড় বোন মর্জিনা আকতারের বিয়ে হয়েছে। এক ছোট বোন রুশনি আকতারেরও বিয়ে হয়েছে। সবার ছোট সাবরিনা ইয়াসমিন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।

সম্প্রতি ওয়াসিমের বাড়িতে গেলে কথা হয় বাবা শফিউল আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াসিমকে হারিয়েছি এক বছর হতে চলল। তার দেহটা কবরে থাকলেও সব সময় মনে হয় সে আমার সঙ্গে আছে। ঘরের সবকিছুতে তার স্মৃতি লেপ্টে রয়েছে। কোনোভাবে স্মৃতি থেকে সে সরে না।’

দেশের জন্য ওয়াসিম প্রাণ দিয়েছেন জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রামে প্রথম শহীদ হয়েছে আমার ছেলে। এটি ভাবতেই আমার বুক গর্বে ভরে যায়। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কেউ যখন ওয়াসিমের নাম উচ্চারণ করে তার সাহসিকতার প্রশংসা করে, তখন মনে হয় আমার ছেলের শহীদ হওয়া সার্থক হয়েছে। ওয়াসিমের কারণে সব জায়গায় সম্মান পাই। এটি ভালো লাগে। তবে পরক্ষণেই মনে হয় আহা আমার ছেলেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি!’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে শফিউলের। কান্না সংবরণ করতে পারেন না। তখন একদম নীরব হয়ে যান তিনি।

আরও পড়ুন
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ মোহাম্মদ ওয়াসিম আকরামের কথা তুললে বাবা শফিউল আলম কান্নায় ভেঙে পড়েন। ২ জুলাই দুপুরে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজার পাড়ার বাড়িতে
ছবি: প্রথম আলো

ছেলে হত্যার বিচার দেখে মরতে চান জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘আমি যখন বিদেশে ছিলাম, তখন ওয়াসিমের মা চট্টগ্রামে একটি মামলা করেছিল। তখন কারা কারা আসামি হয়েছে, সেসব মনে নেই। তবে চকরিয়ার কোনাখালী এলাকার একটি ছেলে নাম রাশেদ, সে আমার ছেলের মূল হত্যাকারী। ওই সময় হত্যাকারী মাঠে যেমন ছিলেন, তেমনি এসি রুমে বসেছিলেন হত্যার নির্দেশদাতাও। হত্যাকারী, পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা, নেতৃত্বদানকারী—আমি সবার বিচার চাই।’

ওয়াসিমের মা জ্যোৎস্না বেগম অসুস্থ। ছেলের মৃত্যুর পর থেকে রোগে-শোকে ভুগছেন তিনি। মাঝরাতেও ‘ওয়াসিম’ বলে ডাক দিয়ে ওঠেন। জ্যোৎস্না বেগম অসুস্থ শরীর নিয়ে এই প্রতিবেদকের সামনে আসেননি। তবে শফিউল আলম বলেন, গত ঈদের সময় পুরো পরিবারের সবাই একসঙ্গে কান্নাকাটি করেছি। যখন ঈদের পাঞ্জাবি পরে বাড়ির পাশের ছেলেরা নামাজে যাচ্ছিলেন, তখন ওয়াসিমের মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ওই সময় পরিবারের সবাই কেঁদেছি। শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো পরিবার।

ছেলের মৃত্যুর পর কার কী সহযোগিতা, সেটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ যাবৎ ১৪-১৫ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। অনুদান বা সাহায্য বড় কথা নয়, একজন শহীদের বাবা হিসেবে, মা হিসেবে যেন প্রাপ্য সম্মানটুকু পাই, সবার কাছে সেটাই চাওয়া।’

আরও পড়ুন