চট্টগ্রামে ধীরে চলছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তার ৫ শতাংশ
বেশির ভাগ মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলায় এজাহার ত্রুটিপূর্ণ। আবার অনেক মামলায় কিছু আসামিকে বাদ দিতে হলফনামা দিয়েছেন মামলার বাদী। এর বাইরে কয়েকটি ঘটনায় ময়নাতদন্ত না হওয়া ও প্রতিবেদন দেরিতে আসার কারণে তদন্ত ধীরগতিতে এগোচ্ছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১৫১টি। গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পার হলেও তদন্ত শেষ হয়েছে মাত্র একটি মামলার। এক বছরে আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ।
পুলিশ জানিয়েছে, বেশির ভাগ মামলায় ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলায় এজাহার ত্রুটিপূর্ণ। আবার অনেক মামলায় কিছু আসামিকে বাদ দিতে হলফনামা দিয়েছেন মামলার বাদী। এর বাইরে কয়েকটি ঘটনায় ময়নাতদন্ত না হওয়া ও প্রতিবেদন দেরিতে আসার কারণে তদন্ত ধীরগতিতে এগোচ্ছে। তবে প্রকৃত অপরাধী যাতে পার না পায়, সেই লক্ষ্যে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৫১টি মামলার মধ্যে ৬৯টি হয়েছে নগর ও জেলার ৯টি থানায়। বাকিগুলো আদালতে দায়ের হওয়া নালিশি মামলা (সিআর)। এসব মামলায় নাম উল্লেখ থাকা আসামির সংখ্যা ১৩ হাজার ৪৫০। অজ্ঞাতপরিচয় আসামির সংখ্যা অন্তত ৩০ হাজার। আসামিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর নাম যেমন রয়েছে, তেমনি আবার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন এমন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন পেশার মানুষও রয়েছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে থানায় হওয়া ৬৯টি মামলায় মোট আসামি ২১ হাজার ৯০৬ জন। এর মধ্যে নামোল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ৭ হাজার ২২৬ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ১৪ হাজার ৬৮০ জন। ১৫ জুলাই পর্যন্ত আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ২০১ জন। আসামির বিপরীতে গ্রেপ্তার ৫ শতাংশ। ধরা না পড়া উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও রেজাউল করিম, কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম, সাবেক কাউন্সিলর নুর মোস্তফা, শৈবাল দাশ রয়েছেন। থানায় হওয়া ৬৯টি মামলার মধ্যে ১৫টিই হত্যা-মামলা। তদন্ত শেষ হওয়া একমাত্র মামলাটিও হত্যার অভিযোগ করা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (উত্তরাঞ্চল) কেন্দ্রীয় সংগঠক রাসেল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর হলেও মূল আসামিদের বেশির ভাগ গ্রেপ্তার না হওয়া দুঃখজনক। আসামিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত পোস্ট করলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। আমাদের রক্ত যাদের হাতে, আমরা তাদের বিচার চাই। তবে নির্দোষ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেটিও আমাদের চাওয়া।’
এক বছর হলেও মূল আসামিদের বেশির ভাগ গ্রেপ্তার না হওয়া দুঃখজনক। আসামিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত পোস্ট করলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। আমাদের রক্ত যাদের হাতে, আমরা তাদের বিচার চাই। তবে নির্দোষ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেটিও আমাদের চাওয়ারাসেল আহমেদ, সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, কিছু কিছু মামলার ক্ষেত্রে শুরুতেই এক দফা ‘বাণিজ্য’ করেছে একটি চক্র। খসড়া এজাহার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে পরে টাকার বিনিময়ে আসামিদের নাম সংযোজন-বিয়োজন করার অভিযোগ রয়েছে। গত ২ জানুয়ারি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ‘মামলা–বাণিজ্যের’ ব্যাপারে নগরবাসীকে সতর্ক থাকতে বলেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ। গত এপ্রিল পর্যন্ত ৪০টি মামলা থেকে ৬৭৫ জন আসামির নাম বাদ দিতে আদালতে হলফনামা দিয়ে আবেদন করেছেন বাদীরা। হলফনামা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চারজন বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি।
যোগাযোগ করা হলে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, মামলার এজাহারে যার নেতৃত্বে হামলা হয়েছে লেখা হয়েছে, বাদীই আবার বলছেন ওই ব্যক্তি হামলায় জড়িত নন। এতে তদন্তে ব্যাঘাত ঘটছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট নগরের লালদীঘির পাড় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মাদ্রাসাশিক্ষার্থী নিজাম উদ্দিন (২১)। ওই দিনই তাঁকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। তাঁর লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। এ ঘটনায় চলতি বছরের ১ জুলাই তাঁর বাবা সাহাব উদ্দিন নগরের কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। নিজামের বাবা সাহাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন সুরতহাল-ময়নাতদন্ত করার মতো পুলিশ-চিকিৎসক, পরিবেশ কিছুই ছিল না। ছেলের লাশ দাফন করতে পেরেছি এটিই বড় কথা’। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) খালিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যা মামলায় অপরাধ প্রমাণে লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য নিহত নিজামের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।’
চট্টগ্রামে থানায় হওয়া ৬৯টি মামলায় মোট আসামি ২১ হাজার ৯০৬ জন। এর মধ্যে নামোল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ৭ হাজার ২২৬ এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ১৪ হাজার ৬৮০ জন। ১৫ জুলাই পর্যন্ত আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ২০১ জন।
আরেকটি হত্যা মামলার বাদী আবদুল মোতালেব। তাঁর ছেলে কাউসার মাহমুদ বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। গত বছরের ৪ আগস্ট কাউসার নগরের নিউমার্কেট গোলচত্বরে গুলিবিদ্ধ হন। পরে ১৩ অক্টোবর ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় করা মামলার এজাহারে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক দেবাশীষ গুহ বুলবুলকে ৫৫ নম্বর এবং নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অমল মিত্রকে ৫৮ নম্বর আসামি করা হয়। অথচ ২০২৩ সালের ৭ মে অমল মিত্র মারা যান। করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেবাশীষ গুহ বুলবুল মারা গেছেন ২০২০ সালে। মামলায় আসামিদের মধ্যে দুবার করে নাম রয়েছে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান, সাবেক কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর, নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম এবং নগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক চন্দন ধরের। মামলাটিতে সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ নামোল্লেখ করা হয়েছে ৯১ জনের। জানতে চাইলে মামলার বাদী ও নিহত কাউসারের বাবা আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘কীভাবে মৃত ব্যক্তি আসামি হয়েছে তা আমি জানি না।’ জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই মনিরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মৃত কিংবা নিরীহ কেউ আসামি হয়ে থাকলে তদন্তে তাঁদের নাম বাদ যাবে।
ডান হাতের এক পাশে গুলি লেগে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাফহীমুল ইসলামের। এ ঘটনায় গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর করা মামলায় তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৭৩৫ জনের নামে এজাহার দেন। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয় ১ হাজার ২০০ জনকে। পুলিশ জানায়, এভাবে বেশির ভাগ মামলায় এজাহারে নামোল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪০০। প্রতিটি মামলায় আসামির সঠিক নাম-ঠিকানা যাচাই করতে স্ব স্ব ঠিকানায় থানার মাধ্যমে ইএস স্লিপ (ইনকোয়ারি স্লিপ) পাঠাতে হয়। এ ছাড়া প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করা লাগে। আসামি বেশি হওয়ায় এসব দেখভাল করতে গিয়ে তদন্তে বাড়তি সময় লাগছে।
হতাহতের ঘটনায় হওয়া তিনটি মামলার তদন্ত করছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রামের এক পরিদর্শক। তিনি জানান, একটি মামলার বাদী এলেও বাকি দুটির বাদীদের বারবার তাগাদা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। সাক্ষীদেরও হাজির করতে পারছেন না।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মাহমুদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় হওয়া মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।