নারী খেলোয়াড় গড়ার কারিগর সুরাইয়া আপা

নারী খেলোয়াড়দের নিয়ে অনুশীলনে ব্যস্ত সুরাইয়া বেগম। সম্প্রতি ঝিনাইদহ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়ামে
ছবি: প্রথম আলো

ঝিনাইদহ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়াম। মেয়েরা এদিক–ওদিক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গল্পগুজব করছেন। বিকেল চারটা বাজতেই বেজে ওঠে বাঁশি। সবাই জড়ো হন এক জায়গায়। শুরু হয় ফুটবল প্রশিক্ষণ।

আরেক বিকেলে গিয়ে দেখা গেল, মাঠে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ চলছে। দলটাও পাল্টে গেছে। কিন্তু প্রশিক্ষক সেই একজনই। এভাবে মৌসুমভেদে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও কাবাডির প্রশিক্ষণ চলে এই স্টেডিয়ামে। এক যুগের বেশি সময় ধরে ঝিনাইদহের মেয়েদের বিভিন্ন খেলার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। তাঁর এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই খেলছেন জাতীয় দলেও।

তাঁর নাম সুরাইয়া বেগম (৪৮)। তিনি ঝিনাইদহ শহরের ফজর আলী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক। বিভিন্ন খেলায় মেয়েদের প্রশিক্ষণের কাজটি তিনি বিনা পয়সায় করেন।

জাতীয় পর্যায়ে খেলছেন, এমন অনেক নারী খেলোয়াড়ের কাছে তিনি প্রিয় সুরাইয়া আপা।সুরাইয়া গত ১৩ বছরে জেলায় ৪ শতাধিক নারী খেলোয়াড় গড়ে তুলেছেন। খেলাধুলায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সুরাইয়া ২০২০ সালে খুলনা বিভাগে শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন।

সুরাইয়া সম্পর্কে খুলনা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মোহামেডান নারী ক্রিকেট দলের কোচ ইমতিয়াজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নারী খেলোয়াড় তৈরিতে তিনি যে অবদান রাখছেন, তা অতুলনীয়।

ছোট থেকেই খেলায় আগ্রহ

সম্প্রতি স্টেডিয়ামে কথা হয় সুরাইয়া বেগমের সঙ্গে। সেদিন হকির প্রশিক্ষণ চলছিল। সুরাইয়া ছাড়াও সহপ্রশিক্ষক ছিলেন আরেকজন। নিজের সম্পর্কে বলছিলেন সুরাইয়া, খেলার প্রতি আগ্রহটা তাঁর শৈশব থেকেই ছিল। থাকতেন ঝিনাইদহ শহরের টিঅ্যান্ডটি পাড়ায়। বিকেল হলেই চলে আসতেন স্টেডিয়ামে। মা–বাবার অনুমতি নিতে হতো। সে সময় মেয়েরা তেমন একটা মাঠে আসত না। তিনি বর্শা, গোলক ও চাকতি নিক্ষেপে ছিলেন জেলায় সেরা।

কথা প্রসঙ্গে সরকারি নুরুন্নাহার মহিলা কলেজের ক্রীড়া শিক্ষক ফরিদ উদ্দিনের তারিফ করলেন সুরাইয়া। তিনি সুরাইয়াকে ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন (বিপিএড) ডিগ্রি নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। ১৯৯৮–৯৯ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে সেই ডিগ্রিও নেন তিনি। ২০০৪ সালে হাটগোপালপুর-ভোমরাডাঙ্গা দাখিল মাদ্রাসার ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেলেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর খেলোয়াড় তৈরির প্রচেষ্টা।

নিজেকেও গড়েছেন

কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েই সুরাইয়া শুরু করেন খেলার দল গঠনের কাজ। মাদ্রাসায় যোগদানের কারণে প্রথমে ছেলেদের নিয়ে তৈরি করেন ভলিবল দল, সেটা ২০০৫ সালের কথা। এই দল নিয়ে খুলনা বিভাগে রানার্সআপ হন। তখন থেকেই আগ্রহ ছিল নারী খেলোয়াড় তৈরির। সুযোগও এসে যায়। প্রশিক্ষণের আগ্রহ দেখে ২০০৮ সালে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা ঝিনাইদহের সম্পাদক নাদিরা আখতার তাঁকে মেয়েদের প্রশিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। শুরু হয় কাবাডি, ভলিবল, অ্যাথলেটিকসসহ মেয়েদের প্রশিক্ষণ।

সুরাইয়া বলেন, এই নাদিরা আখতার ছিলেন ফজর আলী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ২০১০ সালে স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক প্রীতি রঞ্জন রায় অবসরে গেলে নাদিরা আখতারের সহযোগিতায় সেখানে যোগদান করেন। নিজেকে খেলাধুলার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেন। খুলনা ক্রিকেট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নেন। আর ঢাকা কাবাডি ফেডারেশন থেকে নেন কাবাডির ওপর প্রশিক্ষণ।

তিনি গ্রীষ্মকালে চার মাস ফুটবল ও কাবাডির প্রশিক্ষণ দেন। সপ্তাহে ছয় দিন প্রশিক্ষণ চলে। এর মধ্যে তিন দিন ফুটবল, তিন দিন চলে কাবাডির প্রশিক্ষণ। আর এক দিন থাকে ছুটি। ক্রিকেট মৌসুমে সপ্তাহে তিন দিন (মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার) ক্রিকেট প্রশিক্ষণ, আর ছয় দিনই হকির প্রশিক্ষণ চলে বলে জানালেন সুরাইয়া।

খেলোয়াড়দের কথা

ফজর আলী গার্লস স্কুলে যোগদান করে সুরাইয়া পরের বছর প্রথম কাবাডি দল গঠন করেন। প্রথম বছরেই খুলনা বিভাগে রানার্সআপ হন তাঁরা। ২০১৩ সালে কাবাডিতে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। এই দলের খেলোয়াড় টুকটুকি আক্তার একসময় জাতীয় দলে খেলতেন। সম্প্রতি কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছানোর পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি সুরাইয়া বেগম।

সুরাইয়ার গড়া ক্রিকেটার রত্না খাতুন, আমেনা খাতুন, শিখাসহ ১০-১২ জন খেলোয়াড় কোটায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। নয়নতারা, সুমাইয়া সুলতানা, রানী খাতুন, শারমিন আক্তারসহ বেশ কয়েকজন ঢাকায় ক্রিকেট লিগ খেলছেন।

একাডেমি গড়ার স্বপ্ন

দুই সন্তানের জননী সুরাইয়া। বড় ছেলে কে এম শাহরিয়ার ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। ছোট মেয়ে জুয়ায়রিয়া ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তির জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় আছেন।

ঝিনাইদহে মেয়েদের জন্য একটি একাডেমি গড়ার স্বপ্ন দেখেন সুরাইয়া। যেখানে মেয়েরা আসবে, খেলাধুলা শিখবে।