যে রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস    

খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি মং রাজবাড়ির নানুমা দেবী হল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি অস্থায়ী হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ছবি: প্রথম আলো

খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে মানিকছড়ি মং সার্কেলের রাজবাড়ি। এখন এই রাজবাড়িজুড়ে পিনপতন নীরবতা। তবে শানবাঁধানো পুকুরঘাট, দৃষ্টিনন্দন রাজবাড়ি, মঠ-মন্দির দেখে ধারণা করা যায় একসময় এই রাজবাড়ি ছিল লোকজনে সমাগম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে খাগড়াছড়ির এই রাজবাড়ি।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় রাজা মং প্রু সেইন এই রাজবাড়িতে গড়ে তুলেছিলেন চিকিৎসালয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন রাজভান্ডার। যদিও মুক্তিযুদ্ধের এসব কর্মকাণ্ডের জন্য কোনো স্বীকৃতি পাননি প্রয়াত রাজা মং প্রু সেইন।

খাগড়াছড়ি থেকে ৬৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে মানিকছড়িতে অবস্থিত এই রাজবাড়ি। গাড়ি থেকে মানিকছড়ি বাজারে নেমে বাজারের মাঝখান দিয়ে কয়েক শ গজ হেঁটে গেলেই রাজবাড়ি।

সম্প্রতি রাজবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৫ একর আয়তনের এই রাজবাড়িতে সুনসান নীরবতা। লোহার ফটক খুলে রাজবাড়িতে প্রবেশ করতেই বাঁ পাশে চোখে পড়ল শানবাঁধানো পুকুরঘাট। তবে পুকুরে কোনো পানি নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পুকুরটি ব্যবহৃত হয় না বহুদিন। পুকুরের পাশে একতলা মূল রাজবাড়ি ও সেমি পাকা কাছারি ঘর। এই দুটি ঘরের সামান্য দূরত্বে কারুকার্যময় নানুমা দেবী হল ও রাজবাড়ির বৌদ্ধবিহার। নানুমা দেবী হলে ঢুকে চোখে পড়ল হলের চারপাশে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে নকশা করা ২০টি খুঁটি, ১৭টি বুদ্ধমূর্তি, ৭টি চক্র, দৃষ্টিনন্দন ময়ূর অঙ্কিত ১৬টি পেইন্টিং। রাজবাড়ির মূল ভবনে আছে সিংহাসন। বাঘের পায়ের আদলে তৈরি সিংহাসনের কাঠের পায়ায় বাঁধানো আছে বাঘের নখ। অপূর্ব সুন্দর কারুকার্যে তৈরি পালঙ্ক, বিশালকার হাতির দাঁত, তলোয়ার, বন্দুক, তির-ধনুক, রাজ পোশাকসহ বিভিন্ন মূল্যবান নিদর্শনও রয়েছে।

রাজবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মানিকছড়ি ছড়া। ছড়ার ওপারে মহামুনিতে রয়েছে প্রয়াত মং রাজা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের মঠ। ১৮৮৩ সালে নির্মাণ করা আরও একটা বৌদ্ধমন্দির। এ মন্দিরের ভেতরে রয়েছে তৎকালীন বার্মা থেকে নিয়ে আসা অষ্টধাতুর বিশালকার বুদ্ধমূর্তি।

মানিকছড়ি এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মংসা মারমা বলেন, রাজবাড়িতে একসময় সৈন্য-সামন্ত, হাতি-ঘোড়া সবই ছিল। ৩৩ বছর আগে রানি নিহার দেবীর মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয় শূন্যতা। ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় জৌলুশ আর রাজকীয় পরিবেশ। মহামুনির বৌদ্ধমন্দিরটি ঘিরে প্রতিবছর চৈত্র-সংক্রান্তি উপলক্ষে বসে মহামুনি মেলা। আগে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এলেও এখন কেবল নিয়ম রক্ষার মেলা হয়।

রাজবাড়ি সূত্রে জানা গেছে, রাজা কংজয়ের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র কিওজা সেইন ১৮৬১ সালে মানিকছড়ি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। চতুর্থ মং রাজা নিপ্রুসাইনের কোনো ছেলেসন্তান না থাকায় তাঁর একমাত্র কন্যা নানুমা দেবীকে সহকারী মং সার্কেল হিসেবে নিয়োগ দেয় ব্রিটিশ প্রশাসক। ১৩০২ মঘাব্দে নানুমা দেবী তাঁর পিতা চতুর্থ মংরাজা নিপ্রুসাইন বাহাদুরকে উৎসর্গ করে রাজবাড়িতে তাঁর নামেই গড়ে তোলেন নানুমা দেবী হল। আর এই হলেই রাজ্য অভিষেক, খাজনা আদায় ও হেডম্যান কার্বারিদের নিয়ে নানা আচার অনুষ্ঠান হতো। কিছুদিন আগেও নানুমা দেবী হলটি ছিল ভগ্নদশায়। বর্তমানে এটি সংস্কার করে নান্দনিক রূপে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক প্রভাংশু ত্রিপুরার লেখা ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস’ বইয়ের ২০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে—২ এপ্রিল পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক চট্টগ্রাম শহর অধিকৃত হলে সেখানকার মানুষ শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে পলায়ন করেন। পলায়নরতদের একটি অংশ মানিকছড়ি রাজবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মং প্রু সেইন এই অসহায় মানুষদের আশ্রয়, খাদ্যের জোগান ও চিকিৎসা দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ত্রিপুরা রাজ্যে সপরিবার শরণার্থী হয়ে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর নিরাপত্তার জন্য রক্ষিত কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, একটি প্রাইভেট কার ও একটি জিপ গাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাঁকে কর্নেল র‌্যাঙ্ক প্রধান করে একটি ট্যাংক ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। মং চিফ মং প্রু সেইন আখাউড়া, আশুগঞ্জ ও ভৈরবেও যুদ্ধ করেছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি ঢাকায় চলে আসেন।

রাজবাড়িতে থাকা লোকজন জানান, একসময় রাজবাড়ির ফটক সব সময় খোলা থাকলেও বেশ কয়েক বছর ধরে রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নিতে হয় রাজবাড়ির সদস্যদের কাছ থেকে। রাজবাড়ির সদস্যরা অধিকাংশ সময় থাকেন চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায়। রাজ পরিবারের সদস্য মেজ কুমার সুইচিংপ্রু বর্তমানে রাজবাড়ির তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

মং সার্কেলের রাজবাড়ির মূল ভবন
ছবি: প্রথম আলো

খাগড়াছড়ির মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম ত্রিপুরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানিকছড়ি রাজবাড়িটি অসহায় জনতার আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। রাজবাড়ির বিশাল হাঁড়িতে রান্না চলতে থাকে রাতদিন। রাজবাড়ির নানুমা দেবী হলটি রূপ নেই হাসপাতাল হিসেবে। রাজা মং প্রু সেইনের স্ত্রী রানি নিহার দেবী নিজেই ধাত্রী হিসেবে লেগে যান অসুস্থ মা-বোনদের চিকিৎসাসেবায়। হাজার হাজার মানুষের খাবার, চিকিৎসাদানের পাশাপাশি রাজা খাগড়াছড়িকে শত্রুমুক্ত রাখতে নিজেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজাকে ধরার জন্য তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনী থেকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে রাজা মং প্রু সেইনকে কেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, এটি এখনো অজানা রয়ে গেছে।

মারমা গবেষক, লেখক চিংহ্লামং চৌধুরী বলেন, মানিকছড়ি রাজবাড়ি মং সার্কেলের একটি ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ি ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র, গাড়ি, খাদ্য, অর্থসহ রাজবাড়িতে আহতদের জন্য চিকিৎসালয় গড়ে তোলা সহজ ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মং রাজার অবদান অতুলনীয়। কয়েক বছর আগে জেলা পরিষদ থেকে রাজবাড়িকে সংস্কার করা হয়েছে। এই রাজবাড়িকে ধরে রাখা রাজ পরিবারসহ সবার দায়িত্ব।