ছোট হচ্ছে কুতুবদিয়া, মানুষ ছুটছে শহরে

লোনাপানির কারণে ফলছে না ফসল, পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয় পানি। জমি বিলীন হচ্ছে সাগরে।

টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয় ঘরবাড়ি, বিলীন হয় গাছপালা। গত ২৪ নভেম্বর কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার মফজল মিয়া গ্রামেছবি: প্রথম আলো

সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড খুদিয়ারটেক। সেটি এখন কেবল কাগজে-কলমেই আছে। বঙ্গোপসাগরে ভূমি বিলীনের পর এখানকার অন্তত ৩০ হাজার বাসিন্দার ঠাঁই হয়েছে শত কিলোমিটার দূরের কক্সবাজার শহরে। কেবল ১৫টি পরিবার থাকে খুদিয়ারটেকের পাশের তাবলের চরের বেড়িবাঁধের ঢালুতে।

খুদিয়ারটেক ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ারা বেগম পরিবার নিয়ে থাকেন তাবলের চরে। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের শেষ দিকেও খুদিয়ারটেকে ৪০ হাজার মানুষের বসতি ছিল। এখন কেউ নেই। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে খুদিয়ারটেকের অন্তত তিন হাজার একর ভূমি সাগরে বিলীন হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই উপজেলায় মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। লোনাপানির আগ্রাসনে ফলছে না ফসল, পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয় পানি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে জমি বিলীন হচ্ছে সাগরে।

শুধু খুদিয়ারটেক নয়, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল, উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, লেমশীখালী ও বড়ঘোপ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে গত তিন দশকে আরও অন্তত ৩০ হাজার মানুষ দ্বীপ ছেড়েছেন। কুতুবদিয়ার বাস্তুহারা মানুষেরা কক্সবাজার শহরের সমুদ্র উপকূলীয় সরকারি জমির পাশাপাশি চকরিয়া, রামু, পেকুয়া, টেকনাফ, বান্দরবানের লামা, আলীকদম, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, মিরসরাই, রাউজান, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।

গত বছর ২১ থেকে ২৩ অক্টোবর সরেজমিনে দ্বীপের ছয় ইউনিয়ন ঘুরে নানা শ্রেণি–পেশার অন্তত ৩০০ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই উপজেলায় মানুষের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। লোনাপানির আগ্রাসনে ফলছে না ফসল, পাওয়া যাচ্ছে না সুপেয় পানি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে জমি বিলীন হচ্ছে সাগরে।

প্যারাবন ধ্বংসের কারণে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ হয়নি।
বাপা কক্সবাজার জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী

দ্বীপ ছেড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ

জন্মের পর থেকে সমুদ্রের সঙ্গে বাজি ধরে জীবন চলছে আবদুল ওয়াহেদের (৮৫)। নিজের দুই একর জমিতে ধান চাষ, সবজি উৎপাদন করে চলত সুখের সংসার। ঘরে ছিল হাঁস, মুরগি, গরু, মহিষ, ছাগল। এখন সবই স্মৃতি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ওয়াহেদের সংসার তছনছ করে দেয়। ভেসে যায় তাঁর ৪ মেয়ে, কেড়ে নেয় ২ একর ধানিজমি, ৪০ শতাংশ জমির টিনের ভিটেবাড়িও।

উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১৮৭২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত পাঁচটি বড় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়ার অনেকটা অংশ বিলীন হয়েছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপজেলার খুদিয়ারটেক ও রাজাখালী নামের দুটি মৌজা মানচিত্র থেকে মুছে গেছে।

ভাঙতে ভাঙতে এখন দ্বীপের আয়তন ৩০ থেকে ৩৫ বর্গকিলোমিটার বলে মনে করেন কুতুবদিয়ার বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, বর্তমানে উপজেলার লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫৩ হাজার। গত তিন দশকে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে দ্বীপ ছেড়েছে। জমি কমছে। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক মোকাবিলায় উদ্যোগ না নিলে সংকট আরও বাড়বে।

প্রস্তাবিত সুপার ডাইকের উচ্চতা হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার উঁচুতে। ডাইকের ওপরে থাকবে দুই লেনের সড়ক। তীরের দুই দিকে ঢালুতে বসানো হবে বড় বড় সিসি ব্লক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক

বেড়িবাঁধ ভাঙছে, ধ্বংস হচ্ছে প্যারাবন

১৯৮৬ সালে কুতুবদিয়ার চারদিকে প্রায় ১০ হাজার একরের সবুজ বেষ্টনী প্যারাবন সৃজন করা হয়েছিল। ১৯৯০ সালের দিকে চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ তৈরির জন্য সেই প্যারাবন ধ্বংস করতে শুরু করেন প্রভাবশালীরা। বন বিভাগের কুতুবদিয়া রেঞ্জের কর্মকর্তা শামীম রেজা বলেন, বর্তমানে আলী আকবর ডেইল থেকে উত্তর দিকে দক্ষিণ ধুরুং পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটারে ৩০০ একরের মতো প্যারাবন আছে। পলি জমায় নতুন প্যারাবন সৃজন করা যাচ্ছে না।

জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় পাকিস্তান আমলে দ্বীপের চারদিকে ১০ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন দুর্যোগে সেই বাঁধ টিকছে না। দুই বছর আগেও ১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভাঙা ছিল।

কৈয়ারবিল ইউনিয়নের হাজি মফজল মিয়া গ্রামে বাঁশ ও ত্রিপলের ঝুপড়িতে স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন কৃষক আলী হোসেন (৫৬)। ৩২ বছর আগে তাঁর ঘর যেখানে ছিল, সেটা এখন সমুদ্রের দুই কিলোমিটার ভেতরে। ঘূর্ণিঝড়ে ঘরটি বিলীন হওয়ার পর পাশের জমিতে নতুন ঘর বানান। সেটি ভেঙে গেলে আরেকটিতে যান। গত ২৪ বছরে চারবার ঘর হারিয়ে দিশাহারা আলী হোসেন বলেন, এলাকায় আয়রোজগারের ব্যবস্থা নেই। জীবিকার জন্য মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।

প্যারাবনকে উপকূলের রক্ষাকবচ বলেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি বলেন, প্যারাবন ধ্বংসের কারণে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও দুর্নীতির কারণে টেকসই বাঁধ হয়নি।

দ্বীপের চারপাশে এখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৪০ কিলোমিটার মাটির বেড়িবাঁধ আছে বলে জানান সংস্থাটির কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী তানজীর সাইফ আহমেদ। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় সেখানে সুপার ডাইক নির্মাণের চেষ্টা চলছে।

কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, প্রস্তাবিত সুপার ডাইকের উচ্চতা হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ মিটার উঁচুতে। ডাইকের ওপরে থাকবে দুই লেনের সড়ক। তীরের দুই দিকে ঢালুতে বসানো হবে বড় বড় সিসি ব্লক। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আরও কয়েক মাস সময় লাগতে পারে।

পাউবো সূত্র জানায়, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং ফেনী থেকে নোয়াখালীর রহমতখালী পর্যন্ত ৬৪২ কিলোমিটার উপকূল সুরক্ষায় বিশেষ ধরনের বাঁধ বা সুপার ডাইক নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ১৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কুতুবদিয়ায় সুপার ডাইক হবে ৬৩ কিলোমিটার।

সুপার ডাইক নির্মিত হলে বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা খুদিয়ারটেক, আলী আকবর ডেইল ও কৈয়ারবিলের অন্তত ১০ হাজার একর বিরানভূমি নতুনভাবে বসবাস ও চাষাবাদের আওতায় আসবে বলে মনে করেন কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী।

লোনাপানিতে ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য

দ্বীপের মধ্যভাগে বড়ঘোপ বাজারের পাশে ব্যবসায়ী আমির হোসেনের বাড়ি। তাঁর নলকূপে পাঁচ বছর আগেও সুপেয় পানি পাওয়া যেত। এখন লবণপানি ওঠে। ছয় মাস আগে তিনি ৯০০ ফুট গভীর করে আরেকটি নলকূপ বসান। কিন্তু তাতেও সুপেয় পানি পাওয়া যায়নি।

উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে নলকূপ আছে ২১ হাজার। এর মধ্যে অন্তত ১২ হাজার নলকূপের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আল আমিন বলেন, বড়ঘোপ ইউনিয়নের ৪ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের মলমচরসহ কয়েকটি গ্রামে দুই হাজার ফুট নিচে গিয়েও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কুতুবদিয়ার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা নাদিম

খাওয়ার পানির সংকট দূর করতে ‘শহরের সুবিধা গ্রামে’ প্রকল্পের আওতায় পাইপলাইনের মাধ্যমে কৈয়ারবিল ইউনিয়নে ১৩ কিলোমিটার, বড়ঘোপ ইউনিয়নে ১০ কিলোমিটার, লেমশিখালীতে ১২ কিলোমিটার, দক্ষিণ ধুরুং ইউনিয়নে ৭ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে অন্তত দুই হাজার পরিবারের খাওয়ার পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা নাদিম মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কুতুবদিয়ার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।