মাদারীপুরে বেকারদের প্রশিক্ষণের নামে যত অনিয়ম

মাদারীপুর জেলা পরিষদের প্রধান ফটক
ছবি: প্রথম আলো

বেকার যুবক ও নারীদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিনা মূল্যে তিনটি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে মাদারীপুর জেলা পরিষদে। বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্যে এই প্রশিক্ষণ প্রকল্প নেওয়া হলেও প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে সত্যিকারের বেকার খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই কর্মজীবী, কোনো না কোনো পেশায় জড়িত। তাঁরা হয় শখের বশে, নয়তো বিনা পয়সায় সরকারি একটা সনদ পেতেই প্রশিক্ষণে নাম লিখিয়েছেন। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদেরও দেখা গেছে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণে অংশ নিতে। আবার কোনো দিন প্রশিক্ষণে উপস্থিত না হয়ে, এমনকি ঢাকায় বসেও বিনা মূল্যের সেলাই মেশিনটি ঘরে তুলেছেন অনেকে।

অথচ সত্যিকারের বেকার যুবক-নারীরা আবেদন করেও ভর্তির সুযোগ খুব একটা পাচ্ছেন না। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনটি প্রশিক্ষণে বছরে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা খরচ করা হলেও এ রকম অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে সুফল মিলছে না জেলা পরিষদের এই শুভ উদ্যোগের।

২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে মাদারীপুর জেলা পরিষদের ‘দারিদ্র্য নিরসন ও নারী উন্নয়ন’ নামক প্রকল্পটির যাত্রা শুরু। দরিদ্রদের জন্য সেলাই, কম্পিউটার ও মোটর ড্রাইভিং শেখার সুযোগ রাখা হয়েছে এই প্রকল্পে। প্রতি অর্থবছরে ১৫৫ জন নারীকে সেলাই শেখার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানের জন্য প্রত্যেককে একটি করে সেলাই মেশিন দেওয়া হয় বিনা মূল্যে। দ্বিতীয়ত, বছরে ২০০ জন যুবক ও নারীর জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তৃতীয়ত, বছরে ১২০ জন করে বেকার যুবক ও নারীকে মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থীদের দেওয়া হয় সনদসহ এককালীন ৩ হাজার ৩০০ টাকা করে ভাতা আর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণার্থীরা পান সনদ ও ১ হাজার ১০০ টাকার ভাতা। সেলাই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য থাকে বিনা মূল্যে একটি করে সেলাই মেশিন।

শখ-কৌতূহলের প্রশিক্ষণ

২০২২-২৩ অর্থবছরে এই প্রকল্পের অধীনে মাদারীপুরের পাঁচটি উপজেলা থেকেই ড্রাইভিং প্রশিক্ষণে নাম লিখিয়েছেন ১২০ জন। তাঁদের মধ্যে ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা সবাই এক সুরে বলেছেন, মোটর ড্রাইভিং শিখতে যে ধরনের গাড়ি বা হাতে-কলমে শিক্ষা দরকার, তার কোনোটাই ছিল না প্রশিক্ষণে।

শখের বশে ভর্তি হন বলে জানালেন সদর উপজেলার মধ্য হাউসদি এলাকার ওষুধের দোকানি আহসান আজগর (৪৮)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘২২ দিন প্রশিক্ষণে গেলেও গাড়ি স্টার্ট আর বন্ধ করা ছাড়া তেমন কিছুই শিখতে পারি নাই। ট্রেইনারের সহযোগিতায় গ্রামের রাস্তা আর মাঠ দিয়ে দুই–চারটি ঘুল্লা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। আমি অবশ্য ড্রাইভার হওয়ার জন্য এই কোর্সে আসিনি। শখ করেই এখানে ভর্তি হয়েছি।’

প্রশিক্ষণ প্রকল্পের যাচাই-বাছাই কমিটিতে আমি যে সদস্য, সেটা আজই জানলাম। গত ৯ মাসেও কেউ আমাকে জানায়নি। নিশ্চয়ই ওই প্রকল্পে অনিয়ম রয়েছে। বিষয়টি আমি দেখব
নজরুল ইসলাম, উপপরিচালক, স্থানীয় সরকার বিভাগ

কালিকাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান এজাজুর রহমান আকনের ছেলে সদর উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তামিমুর রহমান (২৮) পেশায় ব্যবসায়ী। তিনিও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ড্রাইভিংয়ের।

জানতে চাইলে প্রথম আলোকে এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘কয়েক মাস আগে এমনিতেই ড্রাইভিং ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ব্যস্ততার কারণে প্র্যাকটিক্যাল সব ক্লাস করাও হয়নি। এরপর আর গাড়ি চালানোর সময় পাইনি, তবে শখ আছে। তাই সরকারি ট্রেনিং (প্রশিক্ষণ) থেকে কিছুটা ধারণা নিলাম।’

জেলা পরিষদের ঠিকদার শহীদুল ইসলামও শখের বশে মোটর ড্রাইভিং প্রশিক্ষণটি নেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমনিই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ফ্রিতে কোর্সটা করি। মোটামুটি শিখেছি, তবে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ড্রাইভিং শিখি নাই।’

প্রশিক্ষণ ছাড়াই সেলাই মেশিন

রাজৈর উপজেলার লাকি বেগম (৪০) ও ইভা সরকার (৩৩)। কাগজে-কলমে দুজনই সেলাই প্রশিক্ষণ শেষ করে বিনা মূল্যে দুটি সেলাই মেশিন পেয়েছেন। তবে তাঁরা দুজনই প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন, তাঁদের কোনো প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়নি। তিন হাজার টাকা খরচ করে জেলা পরিষদ থেকে তাঁরা দুজন দুটি সেলাই মেশিন পেয়েছেন।

জানা গেল, লাকি বেগম গৃহিণী হলেও উপজেলার নয়াকান্দি গ্রামের বাড়িতে তাঁর মুরগির খামার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘উপজেলায় চার-পাঁচ দিনের ট্রেনিং হইছিল। খামারে কাজ থাকায় যাওয়া হয় নাই। তা ছাড়া আমি মোটামুটি সেলাইয়ের কাজ আগে থেকেই জানি। পরে প্রশিক্ষক পারুল বেগমের সহযোগিতায় একটি মেশিন পাইছি। মেশিনটা ঘরেই থাকে। মাঝে মাঝে নিজেদের কাজে ব্যবহার করি।’

দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জেলা পরিষদের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এর সুফল ভোগ করছেন কর্মজীবী নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। প্রবাসী অধ্যুষিত জেলায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে না ওঠায় বহু বেকার যুবক ও নারী হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু দেশে গরিবের বেকারত্ব দূর হচ্ছে না। এর একটাই কারণ, প্রকল্পে নজরদারির অভাব রয়েছে; সঠিক জবাবদিহি নেই। যে যাঁর মতো করে প্রকল্প পরিচালনা করছেন। বরাদ্দের টাকা নয়ছয় করে খরচ করছেন। এসব কারণে প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না
ইয়াকুব খান, সভাপতি, জেলা সচেতন নাগরিক কমিটি

ইভা সরকার রাজৈর উপজেলার দীঘিরপাড় এলাকার বাসিন্দা হলেও থাকেন ঢাকায়। বিনা মূল্যে সেলাই মেশিন পাওয়ার আশায় তিনিও জেলা পরিষদের প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। ইভা বলেন, ‘পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় একজন আইনজীবীর সাথে কাজ করছি। সেলাইয়ের কাজ করতে ভালো লাগে, তাই করোনার সময় শখ করে কয়েক দিন মাদারীপুর এসে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখন মেশিনটি ঘরেই রাখা আছে। বাড়িতে গেলে সময় পেলে সেলাইয়ের কাজ করার চেষ্টা করি।’

প্রশিক্ষণ ড্রাইভিংয়ের, ব্যবসা কম্পিউটারের

সদর উপজেলার কুলপদ্বী এলাকার ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম জেলা পরিষদে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মোটর ড্রাইভিংয়ের, কিন্তু ব্যবসা খোলেন কম্পিউটার দোকানের। জানতে চাইলে তরিকুল বলেন, ‘সরকারিভাবে ফ্রিতে ড্রাইভিং শেখানো হয় শুনে ওখানে এক লোক মারফত ভর্তি হই। এটি কোনো প্রকল্প কি না, কিছুই জানি না। কয়েক দিন ক্লাস করে দেখি, ভালো শেখায় না। তাই পুরো কোর্স শেষ করি নাই। তবে সনদপত্র আর কিছু টাকা পেয়েছিলাম।’

যে লোক মারফত ভর্তি হন, তিনি কে—প্রশ্ন করলে তরিকুল বলেন, ‘জেলা পরিষদেরই সাবেক একজন সদস্যের সুপারিশ নিয়ে ভর্তি হই।’ তবে তাঁর নাম বলতে চাননি তরিকুল।

বেকারেরা বঞ্চিত

মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগরিয়া এলাকার ভাগ্য শীল (৩৫) অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি সেলাই শেখার জন্য তিনবার আবেদন নিয়ে জেলা পরিষদে গেছি। প্রতিবার টাইম দেয়, ডাকবে। কিন্তু আর ডাকে না।’ সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই নারী বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, তাই আমরা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না।’

মোটর ড্রাইভিং শেখার জন্য গত বছর ও চলতি বছরেও জেলা পরিষদে আবেদন করেন সদর উপজেলার কুলপদ্বী এলাকার বেকার যুবক শফিকুল ইসলাম। একবারও তাঁর আবেদন গ্রহণ করেনি জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ। আফসোসের সুরে শফিকুল বলেন, ‘আমরা লোক ধরে যাইনি, তাই আমাদের আবেদনও ঝুলে আছে।’

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এ রকম অনেকের কথাই জানা গেছে, যাঁরা সত্যিকারের বেকার এবং কর্মসংস্থানের আশায় জেলা পরিষদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে ভর্তির জন্য আবেদন করেও বঞ্চিত হন।

২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু সদর উপজেলাতেই সেলাই প্রশিক্ষণ নেন ৪০ জন। সেই তালিকায় দেখা যায়, এর মধ্যে ১৭ জনই সুপারিশে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। একই অর্থবছরে এখানে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেন ৪২ জন। সেই তালিকাতেও ১৩টি নামের বিপরীতে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের সুপারিশ দেখা যায়।

যাচাই-বাছাই শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের তালিকা অনুমোদন করেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুনির চৌধুরী। কর্মজীবীরা এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে কীভাবে?-প্রশ্ন করা হলে মুনির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই প্রশিক্ষণগুলোয় বেশির ভাগই বেকার যুবক ও অসহায় নারী সুযোগ পায়। দু-একজন কর্মজীবী আসে না যে তা নয়। তবে সেটা কম। প্রার্থী সিলেকশনের সময় হয়তো ভুল করে হোক বা সমন্বয় করে হোক, দু-একজন এই সুবিধা নিয়ে থাকে, যা আমাদের চোখে ধরাও পড়ে।’

ড্রাইভিং ও সেলাই প্রশিক্ষণে বেশি অনিয়ম হচ্ছে অনুসন্ধানের এমন ফলাফল তুলে ধরলে মুনির চৌধুরী বলেন, ‘সেলাই যাঁরা শেখেন, তাঁরা গৃহিণী। আর ড্রাইভিং শিখতে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে হয়তো কিছুটা কনসিডার করা হয়।’

সুপারিশেই সুযোগ

২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধু সদর উপজেলাতেই সেলাই প্রশিক্ষণ নেন ৪০ জন। সেই তালিকায় দেখা যায়, এর মধ্যে ১৭ জনই সুপারিশে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। একই অর্থবছরে এখানে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেন ৪২ জন। সেই তালিকাতেও ১৩টি নামের বিপরীতে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের সুপারিশ দেখা যায়।

যাঁরা সুপারিশ করছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জেলা পরিষদের সদস্য রোকসানা পারভীন ও মহিউদ্দিন খান এবং সাবেক সদস্য মন্নান লস্কর, স্থানীয় সংসদ সদস্য শাজাহান খানের স্ত্রী বেগম রোকেয়া, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আমেনা খাতুন, ঝাউদি ইউপির চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লতিফা ইয়াসমীন, মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান হাওলাদার, আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। এই সুপারিশকারীদের নাম তালিকায় থাকা মন্তব্যের ঘরে লেখা রয়েছে।

তালিকা দুটি ঘেঁটে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ১২টি সুপারিশ করেছেন জেলা পরিষদের সদস্য রোকসানা পারভীন। দরিদ্র ও বেকারদের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তির ব্যাপারে সুপারিশ করছেন কেন?—প্রশ্ন করা হলে রোকসানা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব শ্রেণির মানুষ আমার কাছে সুপারিশের জন্য আসে। সবাইকে খুশি করতে সুপারিশ করে সই করে দিই। তবে যাচাই-বাছাই করে ভর্তি নেওয়ার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। এখানে তো আমরা কারও ভর্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছি না।’

প্রতিটি সেলাই মেশিন কিনতে খরচ হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। বছরে ১৫৫ জন নারীকে একটি করে সেলাই মেশিন বিতরণে খরচ হয় কম করে ধরলেও ৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ১০ বছরে এই খাতে খরচ হয়েছে রাষ্ট্রের কমপক্ষে ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আমেনা খাতুন বলেন, ‘সুপারিশ করা তো আর অন্যায় নয়। সুপারিশ যে কারও জন্য করা যেতে পারে। আসলে সরকারি এসব জায়গায় সুপারিশ না থাকলে অনেক সময় নাম বাদ পড়ে। তাই সুপারিশ করেছিলাম যেন নামটা চূড়ান্ত থাকে।’

নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করলে আবার সুপারিশ নিতে হচ্ছে কেন—প্রথম আলোর এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সদ্য বিদায়ী) শ্রীনিবাস দেবনাথ বলেন, ‘সুপারিশ নিয়ে অযোগ্য কেউ চাইলেই প্রশিক্ষণে ভর্তি হতে পারবে না। এমন কোনো সুযোগ নেই। কেউ সুপারিশ করলেও যাচাই-বাচাই করেই তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়।’ তালিকার মন্তব্যের ঘরে সুপারিশকারীর নাম কেন লেখা হয়—প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা কেন লেখা, আমার জানা নাই।’

১০ বছরে ৩ কোটি টাকা জলে

‘দারিদ্র্য নিরসন ও নারী উন্নয়ন’ প্রকল্পের নামে প্রতিবছর জেলা পরিষদ থেকে ৩৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই হিসাবে গত ১০ বছর ধরে চলমান এই প্রকল্পে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। জেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, এই টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্থাৎ, বেকার যুবক ও নারীদের কর্মসংস্থানের দিক থেকে তাঁরা শতভাগ সফল। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এর সত্যতা মেলেনি।

তিনটি প্রশিক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় সেলাই ও ড্রাইভিং প্রশিক্ষণে। ড্রাইভিংয়ে প্রশিক্ষণের খরচ হিসেবে জনপ্রতি ৬ হাজার ১০০ টাকা করে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষকে দেয় জেলা পরিষদ। সেই হিসাবে প্রতিবছরে ১২০ জন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য বিআরটিসি গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচসহ পায় ৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা। ১০ বছরে সেই টাকা দাঁড়ায় ৭৩ লাখ ২০ হাজার। বিআরটিসির দুজন প্রশিক্ষক ২২ দিন করে একেকটি কোর্স শেষ করেন।

ওদিকে প্রতিটি সেলাই মেশিন কিনতে খরচ হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। বছরে ১৫৫ জন নারীকে একটি করে সেলাই মেশিন বিতরণে খরচ হয় কম করে ধরলেও ৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ১০ বছরে এই খাতে খরচ হয়েছে রাষ্ট্রের কমপক্ষে ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

এ ছাড়া বছরে ২০০ জন কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থীর প্রত্যেককে ৩ হাজার ৩০০ টাকা করে ভাতা ও সনদ দেওয়া হয়। এভাবে বছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা হিসাবে ১০ বছরে প্রশিক্ষণার্থীদের পেছনেই ব্যয় করা হয়েছে ৬৬ লাখ টাকা। এর বাইরে তিন মাস মেয়াদি কম্পিউটার ও সেলাই শিক্ষা কোর্সে প্রশিক্ষকদের জন্য ক্লাসপ্রতি ৫০০ টাকা করে সম্মানী ভাতা বরাদ্দ রয়েছে।

এভাবে তিনটি প্রশিক্ষণের জন্য জেলা পরিষদ থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা খরচ করলেও দক্ষ কর্মসংস্থান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নজরদারি নেই। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

এই প্রশিক্ষণগুলোয় বেশির ভাগই বেকার যুবক ও অসহায় নারী সুযোগ পায়। দু-একজন কর্মজীবী আসে না যে তা নয়। তবে সেটা কম। প্রার্থী সিলেকশনের সময় হয়তো ভুল করে হোক বা সমন্বয় করে হোক, দু-একজন এই সুবিধা নিয়ে থাকে, যা আমাদের চোখে ধরাও পড়ে
মুনির চৌধুরী, চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ

এ সম্পর্কে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লতিফা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণ প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, তা সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়। বরাদ্দের অনেক টাকা থেকেও যায়। সেই টাকা আবার রিফান্ড করে নেওয়া হয়। এখানে কোনো প্রকার অনিয়ম নেই। যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাদের নানাভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছরই এই প্রশিক্ষণ নিতে বেকার যুবক ও নারীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।’

প্রশাসনিক কর্মকর্তা এমন দাবি করলেও তাঁর কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাইলে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণের পর কর্মসংস্থান হয়েছে, এ রকম কোনো জরিপ বা সমীক্ষা তাঁদের করা নেই। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্তও তিনি উল্লেখ করতে পারেননি। এমনকি, প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও তেমন কোনো উদাহরণ মেলেনি।

নামেই যাচাই-বাছাই কমিটি

বিজ্ঞপ্তি ও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের আবেদন আহ্বান করে জেলা পরিষদ। পরে একটি যাচাই-বাছাই কমিটি করে তার আহ্বায়ক করা হয় জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে; আর সদস্যসচিব করা হয় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও)। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক ও জেলা পরিষদের প্রধান প্রকৌশলী।

যাচাই-বাছাইয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লতিফা ইয়াসমীনকে প্রশ্ন করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘নীতিমালায় লেখা আছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, বেকার যুবক ও নারী, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত নারীরা এখানে আবেদন করতে পারবেন। কর্মজীবীরা কেউ আবেদন করলে সেটা আসতেই পারে। কারণ কর্মজীবীরা তথ্য গোপন করে বেকার হিসেবে আবেদন করে থাকেন। সেটা তো আর যাচাই-বাছাই করা সম্ভব নয়। এত আবেদন যাচাই করতে হলে পুলিশি তদন্ত প্রয়োজন; যা বাস্তবে সম্ভব নয়।’

জেলা পরিষদের তিনটি প্রশিক্ষণ প্রকল্পের প্রশিক্ষণার্থীদের যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শ্রীনিবাস দেবনাথ। অনেকে প্রশিক্ষণ না নিয়েও, এমনকি কেউ ঢাকায় বসেও সেলাই মেশিন পেয়েছেন—এমন প্রমাণ তুলে ধরলে সদ্য বিদায়ী এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’

স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক নজরুল ইসলামকে যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য করা হলেও তিনি গত ৯ মাসের মধ্যে এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণ প্রকল্পের যাচাই-বাছাই কমিটিতে আমি যে সদস্য, সেটা আজই জানলাম। গত ৯ মাসেও কেউ আমাকে জানায়নি। নিশ্চয়ই ওই প্রকল্পে অনিয়ম রয়েছে। বিষয়টি আমি দেখব।’

কমিটির সদস্য হয়েও কেন নজরুল ইসলামকে জানানো হলো না—প্রশ্ন করলে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) লতিফা ইয়াসমীন বলেন, ‘যাচাই-বাছাইয়ের আগে আমরা কমিটির সবাইকে চিঠি দিই। তাঁকেও (নজরুল ইসলাম) চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই হয়তো এসব চিঠির ব্যাপারে জানেন না বলেছেন।’ সেই চিঠি দেখতে চাইলে ‘খুঁজতে হবে’ বলে ব্যস্ততা দেখান তিনি।

নজরুল ইসলামকে চিঠির বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, ‘আমার অফিসে পাঠানো সব চিঠিই দেখা হয়। ওই–সংক্রান্ত কোনো চিঠি আসেনি। তাঁরা ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।’

জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ইয়াকুব খান বলেন, ‘দরিদ্র বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে জেলা পরিষদের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এর সুফল ভোগ করছেন কর্মজীবী নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। প্রবাসী অধ্যুষিত জেলায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে না ওঠায় বহু বেকার যুবক ও নারী হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু দেশে গরিবের বেকারত্ব দূর হচ্ছে না। এর একটাই কারণ, প্রকল্পে নজরদারির অভাব রয়েছে; সঠিক জবাবদিহি নেই। যে যাঁর মতো করে প্রকল্প পরিচালনা করছেন। বরাদ্দের টাকা নয়ছয় করে খরচ করছেন। এসব কারণে প্রকল্পটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হচ্ছে না।’