ছাত্র না হয়েও ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক হত্যা মামলার আসামি
বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে বগুড়ার শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি গঠনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক একটি হত্যা মামলার অভিযুক্ত আসামি। আর সভাপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হওয়া মামলার আসামি। উপরন্তু ছাত্রলীগ নেতা হলেও তাঁর কোনো ছাত্রত্বই নেই।
শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বগুড়ার শেরপুর উপজেলা পরিষদসংলগ্ন এলাকায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী শেখ গোলাম মর্তুজা ওরফে অভিকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গোলাম মর্তুজার স্ত্রী খাদিজা আকতার বাদী হয়ে উপজেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আরিফুর রহমান শুভসহ ১৭ জনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। পুলিশ পরে আরিফুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। এ হত্যাকাণ্ডের জেরে ৩ অক্টোবর প্রথমে আরিফুর রহমানকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। আরও পরে ১৯ ডিসেম্বর শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে জেলা ছাত্রলীগ। একই সঙ্গে নতুন কমিটি ঘোষণার জন্য সাত কার্যদিবসের মধ্যে পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়।
সাংগঠনিক সূত্রে জানা যায়, কমিটি ভেঙে দেওয়া তিন মাস পর গত ২৩ মার্চ সম্মেলনের বদলে বিশেষ কর্মী সভা ডাকা হয়। শেরপুর টাউনক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা কলেজ চত্বরে আয়োজিত ওই বিশেষ কর্মী সভায় শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের ১৩ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহার উপস্থিতিতে এই কমিটি ঘোষণা দেন বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মাহিদুল ইসলাম। বিশেষ কর্মী সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান।
ওই কর্মী সভায় গালিব সরকারকে শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং মো. হুমায়ুন কবির ওরফে ড্যানিকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এ ছাড়া রবিউল হাসান, শাহরিয়ার মাহমুদ ও রাফসান আল হাসানকে কমিটির সহসভাপতি, আনোয়ার পারভেজ ও রাফিউজ্জামান সজলকে যুগ্ম সম্পাদক; নাজমুল হক, নূর সাকাত জিম, মাহতিম সাকিব ও মেজবাহ আল আশরাককে সাংগঠনিক সম্পাদক; মো. নায়মুল হাসানকে গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং ফারদিন আহম্মেদকে ক্রীড়া সম্পাদক ঘোষণা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করায় সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি গালিব সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, এসএসসি পাসের পর ২০১২ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করায় ২০১৬ সালের ২১ জুন তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য তৌফিক হাসান বাদী হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন। সেই মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। এ ছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানে পড়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগে আরও দুটি মামলা হয়। এর একটির বাদী ছিলেন মাসুদ আলম। ২০১৯ সালের ১২ জুন দায়ের করা এই মামলার ২ নম্বর আসামি ছিলেন গালিব সরকার। ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল তাঁর বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেন তৌফিক হাসান।
মামলাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে গালিব সরকার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মোহাম্মদপুরের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ছিলাম। ওই সময় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে উল্টাপাল্টা পোস্ট দিয়ে আমাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফাঁসানো হয়। পরে ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটিতে আমি ৬ নম্বর এবং তৌফিক হাসান ১২ নম্বর সদস্য ছিলেন।’
গালিব সরকারের দাবি, তদন্তে সত্যতা না পেয়ে ২০১৭ সালের ১২ মে পুলিশ আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। পরে এই মামলা আদালত থেকে খারিজ করে দেওয়া হয়। আর মারপিটের দুটি মামলাও তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। গালিব সরকার বলেন, তাঁর ছাত্রত্ব নেই। তবে ছাত্রত্ব টেকাতে নতুন করে শেরপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে রয়েছেন।
শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির নিয়েও নানা ধরনের সমালোচনা আছে। বগুড়ার শাজাহানপুর থানার একটি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর শাজাহানপুর উপজেলার নগর রাজারামপুর গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে আলমগীর হোসেন নামের এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালককে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। ওই ঘটনায় ৩০ ডিসেম্বর নিহত ব্যক্তির ছোট ভাই মনিরুজ্জামান লিমন বাদী হয়ে শাজাহানপুর থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সদ্য ঘোষিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক হমায়ুন কবির।
শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের জিলানি বলেন, মামলার তদন্ত শেষে হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় হুমায়ন কবিরসহ অন্যদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
এ বিষয়ে হুমায়ুন কবির ওরফে ড্যানি প্রথম আলোকে বলেন, এক আত্মীয়ের সঙ্গে অন্যদের জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে মারামারি হয়। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে হত্যা মামলার আসামি হতে হয়। আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়েছে।
হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। আদালতে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত আমাকে দোষী বলা যাবে না।’
শেরপুর উপজেলার কুসুম্বী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিলন হাসান বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাড়ি শেরপুর শহরে। অথচ সম্মেলন ছাড়াই লোক দেখানো কর্মী সভা ডেকে শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়। কমিটির সভাপতি-সম্পাদক দুজনই বিতর্কিত। সভাপতি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করায় আইসিটি মামলার আসামি। সাধারণ সম্পাদক একটি হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।’
বিতর্কিত নেতাদের নিয়ে শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজীব সাহা বলেন, ‘শেরপুর উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে এখনো গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠানো হয়নি। আপাতত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।’