স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ হারাচ্ছে

বরিশাল নগরের পশ্চিম ও পূর্ব, দুই পাড়েই চলছে দখলের মচ্ছব। নদীতে জেগে ওঠা চর দখল করেছেন প্রভাবশালীরা। কেউ দখল করে গড়ে তুলছেন স্থাপনা।

অপরিকল্পিতভাবে সেতু নির্মাণ করায় দুই পাশ থেকে খাকদোন নদের পাড় দখল হয়ে সংকুচিত হয়েছে। পরিণত হয়েছে মরা নদে। সম্প্রতি বরগুনা সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া এলাকায়ছবি: মোহাম্মদ রফিক

বরিশাল বিভাগের ৪২টি নদ-নদী দখল, দূষণ ও ডুবোচরের কারণে স্বাভাবিক চরিত্র হারাচ্ছে। এসব নদীর ৬২৯ কিলোমিটার ডুবোচরের কারণে নৌপথ সংকুচিত হয়ে বাড়ছে ঝুঁকি। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার বিশ্ব নদী দিবস। নদী রক্ষায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরিশাল অঞ্চলের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, এসব নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ২০১৮ সালে সমীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য লোকবলও নিয়োগ করা হয়েছিল। বদলি হয়ে আসার পর এর অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি আর জানেন না।

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার বুড়াগৌরাঙ্গ, দাড়ছিঁড়া, রামনাবাদ, আগুনমুখা, ডিগ্রিসহ সব নদ-নদী, মোহনায় সৃষ্ট অসংখ্য ডুবোচরের কারণে ব্যাহত হচ্ছে নৌ যোগাযোগ। প্রমত্ত ডিগ্রি নদের মাঝখানে বিশাল ডুবোচর জেগে ওঠায় গলাচিপা-রাঙ্গাবালীতে নৌ চলাচল হুমকিতে পড়েছে। শুধু জোয়ারের সময় চলাচল করতে পারলেও ভাটার সময় এ পথে লঞ্চ-ট্রলার কিছুই চলাচল করতে পারে না। গত কয়েক বছরে বুড়াগৌরাঙ্গ নদের চর কাজলসংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে।

নদীগুলো রক্ষা করতে হলে প্রথমে এসবের হাইড্রোলজিক্যাল সমীক্ষা চালিয়ে নদীর মানচিত্র তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
রফিকুল আলম, বাপার বিভাগীয় সমন্বয়কারী

পাউবো বরিশাল অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বর্তমানে এ অঞ্চলের সব নদীর ব্যবস্থাপনার জন্য আরেকটি সার্ভে করছি। এর ভিত্তিতে প্রতিটি রিভার সিস্টেম সচল রাখতে আলাদা আলাদা প্রকল্প নেওয়া হবে। এরই মধ্যে এ ধরনের তিন থেকে চারটি প্রকল্প প্রস্তাব আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। পর্যায়ক্রমে সব নদীর প্রবাহ সচল করতেই এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে।’

পিরোজপুরের কচা ও বলেশ্বরের অবস্থা আরও বেহাল। বলেশ্বর নদের বিশাল অংশ এখন মৃত। যতটুকু অস্তিত্ব আছে, তা-ও ডুবোচর পড়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। নৌযানসহ ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা-পিরোজপুর-বরিশাল-মোংলা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র নৌপথ কচা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে উঠছে বড় ডুবোচর। ফলে ভাটির সময় ছোটখাটো নৌযানও ডুবোচরগুলোতে আটকে যাচ্ছে।

ইন্দুরকানীর চরখালী এলাকায় কয়েক দশক আগে জেগে ওঠে একটি বিশাল চর। এর ঠিক পশ্চিম পাশে টগড়া ফেরিঘাট এলাকায় কয়েক বছর ধরে জেগে উঠছে নতুন একটি চর। ডুবোচর থাকায় দেশি-বিদেশি নৌযান চলাচল এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। ভাটার সময় দেশি-বিদেশি বড় জাহাজ চলাচল করতে পারছে না। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এ নৌপথে ছয়-সাত বছর ধরে নৌযান চলাচল একেবারেই কমে গেছে। একইভাবে দখলের কারণে বরগুনার খাকদোন নদটি মৃত্যুর প্রহর গুনছে। নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর সীমিতভাবে খনন করে এর কিছু অংশ সচল রেখে নৌ চলাচল স্বাভাবিক রাখলেও নদটির পূর্বাংশে প্রায় ২০ কিলোমিটার মৃতপ্রায়।

পায়রা, বিষখালী ও কীর্তনখোলার একই অবস্থা

দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নৌরুট হলো পায়রা, বিষখালী ও কীর্তনখোলা নদী। এ তিন নদীর সঙ্গে ঢাকা ও বঙ্গোপসাগরের সরাসরি নৌ যোগাযোগ থাকায় এ নৌপথ খুব গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) দ্বিতীয় শ্রেণির নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত পায়রা নদীর বরগুনা অংশে চরপাড়ায় ১ কিলোমিটার, বুড়িরচরে ৫ কিলোমিটার, লোচা থেকে শুরু করে ওয়াপদা স্লুইসগেট পর্যন্ত ২ কিলোমিটার, জাঙ্গালিয়ায় ২ কিলোমিটার, ডালাচারা থেকে তিতকাটা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার ও কাঁকচিড়া থেকে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিশাল ডুবোচর রয়েছে। বরগুনার আমতলী ফেরিঘাট এলাকায় কয়েক কিলোমিটারজুড়ে বেশ কয়েকটি ডুবোচরের সৃষ্টি হয়েছে। এতে এ স্থান দিয়ে ভাটার সময় ফেরিসহ কোনো নৌযান চলাচল করতে পারছে না। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর অবস্থাও একই। পাঁচ হাজারের বেশি দখলদার নদীটি গিলে খাচ্ছেন। এর মধ্যে চার হাজারের বেশি দখলদারের নাম আছে খসড়া তালিকায়। এতে নদীর দুই পাড় সংকুচিত হচ্ছে। হুমকিতে পড়ছে নদীর জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ-প্রকৃতি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও জাতীয় নদী রক্ষা আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদী আমাদের প্রাণ ও সংস্কৃতির অংশ। কেননা, নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেক উপকারী উপাদান আছে, যার মাধ্যমে নদী, ভূমি ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জলজ, প্রাণিজ উদ্ভিদ, প্রাণী, কৃষি ও জীবন-জীবিকাকে সমৃদ্ধ করে। তাই নদী না বাঁচলে আমাদের প্রাণপ্রবাহ থমকে যাবে।’ নদীগুলো রক্ষা করতে হলে প্রথমে এসবের হাইড্রোলজিক্যাল সমীক্ষা চালিয়ে নদীর মানচিত্র তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

বরিশাল নগরের পশ্চিম ও পূর্ব, দুই পাড়েই চলছে দখলের মচ্ছব। নদীতে জেগে ওঠা রসুলপুর চর, মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়ার চর, কর্ণকাঠি চর, পলাশপুর চর, খোন্নারের চর, বাড়িয়ার চর ও দপদপিয়া ফেরিঘাট-সংলগ্ন এলাকা দখল করেছেন প্রভাবশালীরা। কেউ নদীর পাড়-সীমানা দখল করে গড়ে তুলছেন বিভিন্ন স্থাপনা। আবার কেউ নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলছেন ইট, বালু, পাথর ও কয়লা বিক্রির ডিপো ও লঞ্চ তৈরির ডকইয়ার্ড কিংবা ওষুধ ও সিমেন্টের কারখানা।