দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, রাতে খাবার বিক্রি করেন মাহবুব

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুব মোর্শেদ পড়াশোনার পাশাপাশি খাবারের দোকান চালিয়ে নিজের খরচ মেটান। রংপুর নগরের পার্কমোড়ে তাঁর দোকান
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহবুব মোর্শেদ। দিনে ক্লাস করেন। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খাবার বিক্রির কাজ করেন। নিজে রান্না করে নিজেই খাবার পরিবেশন করেন। এ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালান। বাড়িতে মা-বাবা, ভাইবোনদের জন্য টাকা পাঠান।

মাহবুব মোর্শেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়েন। বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায়। বাবা আতিয়ার রহমান ও মা আমিনা খাতুন। মাহবুবরা তিন ভাইবোন। তিনি সবার বড়। বোন তানিয়া আক্তার কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। ছোট ভাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে মাহবুব দুই বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে তিন হাজার টাকায় একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ‘ভার্সিটি ক্যাফে’ নামে খাবারের হোটেল দেন। সেখানে পোলাও–মুরগির মাংস হাফ প্লেট বিক্রি করছেন ৫০ টাকায়। পরিমাণে একটু বেশি দিয়ে ৯০ টাকা, আরও একটু বেশি দিয়ে ১১০ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি। আরও আছে বিরিয়ানি, নুডলস ও চাউমিন।

এ খাবারের দোকানে মাহবুব একাই সবকিছু করেন। নিজে রান্না করেন। খাবার পরিবেশনও করেন তিনি। হাঁড়িপাতিল ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে বাজার করা—সবকিছু একাই সামলে নেন। কাজের জন্য একটি ছেলে ছিল, সে এখন থাকে না।

সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় মাহবুবের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি দোকান। কিছু টেবিল–চেয়ার আছে। একসঙ্গে ২০ জনের মতো বসতে পারেন। সবার সামনে ছোট্ট একটি রান্নাঘরে রান্না করছেন নানা পদ।

প্লেট পরিষ্কার করে উপস্থিত ক্রেতাদের টেবিলে নিজেই খাবার পরিবেশন করছেন। পোলাও–মাংসের সঙ্গে এক টুকরা লেবু ও দুই টুকরা শসা আছে। নলকূপের পানি বোতলে ভরে খাবারের টেবিলে দিতে ভুলছেন না। খাবার শেষে নিজেই টিস্যু পেপার দিয়ে ক্রেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলছেন, ‘খাবার কেমন লাগল? আবার আসবেন কিন্তু।’

খাবারের দোকানে মাহবুব রান্না থেকে শুরু করে পরিবেশন— একাই সবকিছু করেন
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সাইদুর জামান বলেন, ‘এখানে প্রায়ই খাওয়া হয়। দামে কম ও সুস্বাদু।’

কাজের ফাঁকে মাহবুবের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে এসে বিকেলে রান্না করি। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে তা গরম করে ক্রেতাদের দিই।’ একসঙ্গে এত কাজ কীভাবে সম্ভব—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে থাকলে সম্ভব। তা ছাড়া লেখাপড়ার খরচ যে নিজেকে বহন করতে হবে! বাবার ছোট মুদিদোকানের ব্যবসায় দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে এ কাজ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ খুঁজে পাইনি।’

মাহবুবের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোটবেলায় মায়ের কাছে সব ধরনের রান্না শিখেছেন। এখনো মায়ের কাছে ফোন দিয়ে রান্নার রেসিপি জেনে নেন। তাঁর এই ছোট্ট দোকানে বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিক্রিবাট্টা যা হয়, সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০০-৬০০ টাকা লাভ হয়। এ ছাড়া মাসে অন্তত দুটি অর্ডার আসে। এসব অর্ডারে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার খাবার বিক্রি হয়। সেখানে লাভ থাকে। এ টাকা উপার্জন করে তিনি নিজের খরচ চালান। মায়ের জন্য শাড়ি ও ভাইবোনের জামাকাপড় কেনেন। ছোট ভাইকে লেখাপড়ার জন্য কিছু টাকাও পাঠান।

এ দোকান শুরু করতে টাকার জোগান কীভাবে হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব বলেন, ‘আমার এক পরিচিতজন আমাকে এই দোকানের জামানত বাবদ আড়াই লাখ টাকা, বাসনপত্র ও চেয়ার–টেবিল কেনা বাবদ ৬৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। এই টাকা আমি পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করব। কিন্তু কোনো লভ্যাংশ নেবেন না তিনি।’

এ কাজ করতে গিয়ে লেখাপড়ার অসুবিধা এবং বন্ধুমহলে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় কি না জানতে চাইলে মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ‘বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সাধারণত খুব একটা পড়াশোনা হয় না। এই সময়টাকে আমি কাজে লাগিয়েছি। কেননা নিজের কাজ নিজে করতে হবে। এখানে লাজলজ্জার কোনো বিষয় নেই। এ কাজ করে আমি টাকা উপার্জন করছি, ভাইবোন ও মা-বাবাকে কাপড় কিনে দিচ্ছি; এটি আমার কাছে আনন্দের বিষয়। কে কী ভাবল, সেটি দেখার বিষয় নয়।’