টাকা দিলে সব পাওয়া যায়

সম্প্রতি কারাগার থেকে দুজন কয়েদি ও একজন হাজতি মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম আলোর কাছে নানা অভিযোগ করেন।

  • এক কক্ষে ১০০ থেকে ১৩০ জন বন্দী।

  • ‘প্রভাবশালী’ কয়েদিরা বিক্রি করেন ইয়াবা ও গাঁজা।

  • তিন বেলার খাবার অত্যন্ত নিম্নমানের ও পরিমাণে কম।

  • ২০০ থেকে ৩০০ বন্দীর কাছে মুঠোফোন।

  • অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করলেই নির্যাতন।

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার
ছবি : সংগৃহীত

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি ও কয়েদিদের তিন বেলা যে খাবার দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের ও পরিমাণে কম। একেকটি কক্ষে ১০০ থেকে ১৩০ জন বন্দী থাকেন গাদাগাদি করে। দিনে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা থাকে না পানি। ছোট ছোট কারণে হাজতি ও কয়েদিদের ওপর করা হয় নির্যাতন। এভাবে একদিকে সাধারণ বন্দীদের চলছে অমানবিক কারাবাস, অন্যদিকের চিত্রটা আরও ভয়াবহ।

প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কারাগারের ভেতরে চলে অবাধে মাদক সেবন। ‘প্রভাবশালী’ ২০০ থেকে ৩০০ বন্দীর কাছে রয়েছে মুঠোফোন। এ ছাড়া অসুস্থতা ছাড়াই হাসপাতালের শয্যায় আয়েশে কাটছে অনেক ‘সচ্ছল’ বন্দীর দিন।

সম্প্রতি দুজন কয়েদি ও একজন হাজতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম আলোর কাছে এসব অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া গত এক সপ্তাহে আদালতে হাজিরা দিতে আসা অন্তত ২৫ জন কারাবন্দীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁদের বক্তব্যেও এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

শহরতলির বাদাঘাট এলাকায় সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের অবস্থান। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুই হাজার বন্দীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এ কারাগারে বর্তমানে ২ হাজার ৬১৩ জন বন্দী আছেন।

কথা হলে ২৮ জন বন্দী ও হাজতি বলেন, অনিয়ম যেন ধরা না পড়ে, সে জন্য কারাগারের ভেতরের অধিকাংশ ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাও বিকল করে রাখা হয়েছে। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলার মো. সাখাওয়াত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন এ রকম কোনো বিষয়ই নেই।

অবাধে মাদকের কেনাবেচা

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া তিনজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর কারাগারের ভেতরে অনেক বন্দী অবাধে মাদক সেবন করেন। কয়েকজন কারারক্ষীর ‘নিযুক্ত’ কয়েদিরা ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রি করেন। এর বাইরে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে অনেক হাজতি স্বজনদের কাছ থেকে মাদক নিয়ে আসেন।

ওই তিনজনের একজন বলেন, মূলত জৈন্তাপুরের যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি মুহিব মিয়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত নাসিরের নেতৃত্বে মাদকের বেচাকেনা চলে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০টি ইয়াবা সেবন হয় কারাগারে। একেকটি ইয়াবা বড়ি ২৫০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। এর বাইরে অনেক বন্দী প্রকাশ্যে গাঁজা সেবন করেন।

২০০ থেকে ৩০০ ‘প্রভাবশালী’ বন্দীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে মুঠোফোন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব মুঠোফোন তাঁরা সার্বক্ষণিকভাবে নিজেদের কাছে রাখেন। তাঁরা নিয়মিত বাসায় যোগাযোগ করেন। এমনকি কারাগারে বসেই ব্যবসার কাজ সারেন মুঠোফোনে।

মাদকের পাশাপাশি কারাগারের ভেতরে শিশুদের ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। সদ্য মুক্তি পাওয়া ওই ব্যক্তি বলেন, সংশোধনাগারে থাকা শিশু ও কারাগারে নতুন আসা হাজতিদের দুই থেকে তিন হাজার টাকায় মাসভিত্তিক চুক্তিতে কারারক্ষীরা পুরোনো কয়েদির কাছে ‘থাকার সুযোগ’ করে দেন।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জেলার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কারারক্ষীরা মাদক কেনাবেচায় জড়িত—এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা একটা তথ্য।

‘রোগী সেজে’ হাসপাতালে

সদ্য মুক্তি পাওয়া দুজন কয়েদি প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে একেকটি কক্ষে ১০০ থেকে ১৩০ জন বন্দী রাখা হয়। এ ছাড়া ‘সচ্ছল’ বন্দীরা টাকার বিনিময়ে কারাগারের অভ্যন্তরের হাসপাতালে ‘রোগী সেজে’ থাকছেন।

এ জন্য প্রতি মাসে তাঁদের পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা করে কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন যশোবন্ত ভট্টাচার্যকে দিতে হয়। অথচ অনেক বয়স্ক ও প্রকৃত রোগী হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছেন না।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে যশোবন্ত ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ১৬৫ শয্যার হাসপাতালে এখন ৯৫ থেকে ৯৬ জন বন্দী চিকিৎসাধীন। ফলে অনেক শয্যা ফাঁকা আছে। প্রকৃত রোগীদেরই হাসপাতালে ঠাঁই দেওয়া হয়।

নিম্নমানের খাবার ও নির্যাতনের অভিযোগ

আদালতে হাজিরা দিতে আসা একাধিক বন্দী বলেছেন, দিনে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা কারাগারে পানি থাকে না। হাজতি ও কয়েদিদের তিন বেলা যে খাবার দেওয়া হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। পরিমাণেও খুব কম। এ নিয়ে অভিযোগ করলে উল্টো নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়। তাই ভয়ে অনেকে মুখ খোলেন না।

কারাগারের বন্দীদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য পণ্য লুটপাট হয় অভিযোগ করে সদ্য মুক্তি পাওয়া এক ব্যক্তি বলেন, সকালে নাশতার সঙ্গে দেওয়া সবজি মুখে দেওয়া যায় না। দুপুর ও রাতে যে ভাত দেওয়া হয়, তা সব সময়ই কম সেদ্ধ করা হয়—যাতে বন্দীরা কম খান।

তবে কারাগারে খাবারের মান অত্যন্ত ভালো বলে মনে করেন জেলার। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কোনো বন্দীর মুঠোফোন রাখার সুযোগ নেই। এ ছাড়া পানির কোনো সংকট নেই। অনেক সময় পাম্প বিকল হলে দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করা হয়। তবে অবকাঠামোর কারণে কিছুটা সমস্যা আছে।

একাধিক হাজতি ও কয়েদি অভিযোগ করেছেন, কারা কর্তৃপক্ষের অনিয়মের প্রতিবাদ করলে বা তাঁদের সামান্য ভুল পেলে গামছা দিয়ে হাত বেঁধে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হয়। খোদ জেলারের বিরুদ্ধে এমন একাধিক অভিযোগ রয়েছে।

মারধরের অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মারধর করা হবে কেন? কারাবিধি অনুযায়ী যেসব শাস্তি প্রয়োগ করা দরকার, নিয়ম অনুযায়ী সেসবই করা হয়।’

এসব অভিযোগ তিনি পাননি বলে দাবি করেছেন সিলেট বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) মো. কামাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসে এবং সত্যতা পাই, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’

সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শক বোর্ডের সদস্য লেখক ও সংগঠক আফতাব চৌধুরী সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে কারাগার পরিদর্শন করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারাগার–সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে বন্দীরা ভয়ে আমাদের কাছে সমস্যা ও সংকটের কথা বলতে চান না। এরপরও কিছু অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা পেয়েছি। মাদক সেবন, খাবারের নিম্নমান, বন্দীদের কাছে মুঠোফোন থাকা, কারা হাসপাতালের অন্তত ৭৫ ভাগ রোগী সুস্থ—এসব বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। তবে ধর্ষণের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি।’