‘সন্তানের লাশের ভার আমার কাঁধেই দিল আল্লাহ!’
‘আব্বা, ইফতারি করছ?’ ছেলে বলেছে, ‘করছি বাবা।’ গতকাল সোমবার ইফতারের পরে মুঠোফোনে ছেলের সঙ্গে পুলিশ কনস্টেবল আবদুল মোতালেবের এটাই ছিল শেষ কথা। এরপর আজ মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে তিনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন মুঠোফোন বেজে ওঠে। ছেলের মুঠোফোন থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি বলেন, ‘এই মোবাইল ফোনধারী ছেলেটি রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, অবস্থা খারাপ। ছেলেটি আপনার কী হয়?’
কর্মস্থলে থাকা আবদুল মোতালেব বিছানা ছেড়ে উঠে বসেন। ফোন দেন স্ত্রীকে। সঙ্গে পরিচিতজনদের। দুর্ঘটনাস্থলের ঠিকানা নিয়ে ছুটতে থাকেন স্বজনেরা। কিন্তু ততক্ষণে আবদুল মোতালেবের মুঠোফোনে আবার খবর আসে, ছেলে মারা গেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে আজ মঙ্গলবার সকাল আটটার দিকে বদরগঞ্জ-রংপুর সড়কের লাহিড়ীরহাটের অদূরে। কনস্টেবল আবদুল মোতালেবের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভার মাস্টারপাড়া গ্রামে। তিনি দিনাজপুরের হাকিমপুর থানায় কর্মরত। তাঁর ছোট ছেলে সাজ্জাদ হোসেন (১৯) আজ সকালে বদরগঞ্জ থেকে রংপুরের টিএমএসএস পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইজিবাইকে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। সাজ্জাদ বেসরকারি ওই পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার টেকনোলজিতে পঞ্চম সেমিস্টারে পড়াশোনা করতেন। আবদুল মোতালেবের আরও এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে।
আজ সন্ধ্যার দিকে বদরগঞ্জের মাস্টারপাড়া গ্রামে ঢুকতেই দেখা গেল থমথমে পরিবেশ। গ্রামের লোকজনকে দেখা গেল শোকাচ্ছন্ন। একজন দেখিয়ে দিলেন আবদুল মোতালেবের বাড়ি। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, বাড়ির আঙিনায় লাশ খাটিয়ার ওপরে। গোসল করানোর পর সাদা কাপড়ে লাশ মোড়ানো হয়েছে। পাশে কয়েকটি চেয়ার। আঙিনায় ছিল কিছু মানুষ।
কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আবদুল মোতালেব কফিনের পাশে চেয়ারে বসে ফ্যালফ্যাল করে ছেলের কফিনের পাশে তাকিয়ে থাকেন। পরে বুক চাপড়ে তিনি বলতে থাকেন, ‘দুনিয়ায় বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের ভার বেশি; সেই সন্তানের লাশের ভার আমার কাঁধেই দিল আল্লাহ! এই ভার কি আমি বহন করতে পারব? আমার বাবা (ছেলে) রোজা ছিল। আমার নিষ্পাপ সন্তান বেহেশত যাবে। আল্লাহ তুমি ওকে বেহেশত দান করিও।’ এরপর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে ছেলের কফিনের পাশে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে তিনি বলেন, ‘বাবা, তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে গেলে? ভালো থেকো বাবা...।’
পরে উপস্থিত লোকজন ধরাধরি করে সেখান থেকে আবদুল মোতালেবকে এনে চেয়ারে বসান। এ সময়ে তাঁর স্ত্রী ফরিদা খাতুন ছিলেন ঘরে। তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। প্রতিবেশীরা জানান, আহাজারি করতে করতে মায়ের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। তিনি ঘরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।
সেখানেই কথা হয় নিহত সাজ্জাদের সহপাঠী একরামুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাজ্জাদের মতো ভালো ও মেধাবী বন্ধু আমার জীবনে আমি পাইনি। হয়তো ভালো মানুষ পৃথিবীতে কম সময় থাকে। ঘটনা জানার পরেই আমি বগুড়ার ফাঁসিতলা থেকে তার বাড়িতে ছুটে এসেছি।’ আরেক সহপাঠী গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বন্ধন কুমার শীলও সাজ্জাদের সম্পর্কে একই ধরনের কথা বলেন। কথা বলার সময়ে দুজনের কণ্ঠ ছিল ভেজা, চোখ বেয়ে ঝরছিল পানি।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ কনস্টেবল আবদুল মোতালেব কর্মস্থলেই থাকেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা বেগম সন্তানদের পড়াশোনার কারণে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন রংপুর মহানগরে। রোজা শুরু হওয়ায় তিনি সন্তানদের নিয়ে বদরগঞ্জের বাড়িতে আসেন। আজ সকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু কাগজপত্র তুলতে বদরগঞ্জ থেকে রংপুরে যাচ্ছিলেন সাজ্জাদ। তিনি একটি ইজিবাইকে ছিলেন। পথে ইজিবাইকটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে খাদে উল্টে গেলে মাথা ও বুকে আঘাত পান সাজ্জাদ। উপস্থিত লোকজন হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। আজ রাত ১০টায় জানাজা শেষে সাজ্জাদের লাশ শাহাপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে তাঁর পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুর রহমান বলেন, দুর্ঘটনার স্থান রংপুর সদরে। আইনগত ব্যবস্থা সেখানেই নেওয়া হবে।