ছুটিতে সিলেটের আকর্ষণীয় জায়গাগুলো যেভাবে ঘুরে দেখতে পারেন
কারও শখ চা-বাগানের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে ঘুরে বেড়ানো। কেউ কেউ পাহাড়-টিলার নির্জনতায় কিংবা হাওরের পানিতে ডুব দিতে ভালোবাসেন। অনেকে আবার একাকী কিংবা পরিবার–পরিজন নিয়ে রিসোর্ট অথবা বাংলোয় কয়েকটা দিন আয়েশে কাটাতে চান। এমন সবকিছুরই সমাহার রয়েছে সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত সিলেটে।
পর্যটকেরা সাধারণত বর্ষা মৌসুমেই সিলেটে বেশি আসেন। এখন শুষ্ক মৌসুম। তবে এ সময়েও বেশকিছু স্থানে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ভিড় করেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোয় এসব জায়গা থাকে লোকে–লোকারণ্য। এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতে ঘুরে দেখতে পারেন সিলেটের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলো। মোটামুটি তিন দিন সময় হাতে থাকলে সিলেটের আকর্ষণীয় জায়গাগুলো আয়েশ করে ঘুরে দেখা যায়। কেউ কেউ এক–দুদিন সময় নিয়েও সিলেট ঘুরে আসতে পারেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ায়ী সৌন্দর্যের টানে সব মৌসুমেই সিলেটে দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা ভিড় জমান। এবারের ছুটিতে লাখো পর্যটক সিলেটে আসবেন বলে আমরা ধারণা করছি। পর্যটকদের সুবিধার্থে স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।’
শহরে ঘোরাঘুরি
প্রায় সাত শ বছরের পুরোনো শহর সিলেট। এর আনাচকানাচে রয়েছে পুরোনো সব ঐতিহ্যের চিহ্ন। সফরের প্রথম দিন পর্যটকেরা শহর ও শহরতলীতে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। রিকশা কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে যেকোনো স্থানেই যাওয়া যায়। হাওয়াপাড়া, তাঁতীপাড়া, দরগামহল্লা, কাষ্টঘরসহ বিভিন্ন এলাকায় ঐতিহ্যবাহী পুরোনো ‘আসামটাইপ বাড়ি’ রয়েছে। স্থাপত্যশৈলীর অনুপম এসব নিদর্শন দেখা নেওয়া যেতে পারে।
আসামটাইপ বাড়ি দেখতে গেলে সিলেট শহরের টিলাগড়ে অবস্থিত মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজেও যাওয়া যেতে পারে। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের ছাত্রাবাস এমন স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি করা হয়েছে। টিলাবেষ্টিত এ কলেজের সামান্য দূরেই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই টিলাগড় ইকোপার্ক। উঁচু টিলায় সারি সারি লম্বা গাছ আর বন্য প্রাণী দেখতে ১১২ একর আয়তনের ইকোপার্কটিতেও অনেকে নিয়মিত ভিড় জমান।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শহরের ভেতরে অবস্থিত দৃষ্টিনন্দন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমা; দেশ-বিদেশে সিলেটের প্রতীক হিসেবে পরিচিত সুরমা নদীতে স্থাপিত ধনুকের মতো বাঁকা কিনব্রিজ; কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের আদলে প্রতিষ্ঠিত সারদা স্মৃতি ভবন; ধোপাদিঘির পার ওয়াকওয়ে; বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান; এম সাইফুর রহমান পার্ক, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস); মিউজিয়াম অব রাজাস (হাসন রাজা জাদুঘর); ওসমানী জাদুঘর, অ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ড দেখতেও অনেকে আগ্রহী হন। শহরতলীতে অবস্থিত লাক্কাতুরা, মালনীছড়া, তারাপুর ও খাদিম চা-বাগানেও পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়।
পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, শহরের ভেতরে অবস্থিত হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করতেও ছুটিতে অনেকে সিলেটে আসেন। শাহজালাল দরগাহে থাকা শাহজালালের চিল্লাখানা, কূপ, জালালি কবুতুর, বৃহৎ আকৃতির গজার মাছ আর তৎকালীন সময়ে ব্যবহৃত ডেকচিও অনেকে আগ্রহ নিয়ে দেখেন। মূলত হাজারো ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটি পেলেই সিলেটে আসেন। এবারের ঈদের বন্ধেও এ দুটো স্থানে উপচে পড়া ভিড় থাকবে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মুকির হোসেন চৌধুরী বলেন, শহরের যেকোনো স্থান থেকেই প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে রিকশা করে যাওয়া যায়। তবে ভালো হয়, সারা দিনের জন্য একটি অটোরিকশা ভাড়া করে নিতে পারলে। এতে বড়জোড় ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা খরচ পড়বে। ওই অটোরিকশায় নিশ্চিন্তে ধর্মীয় স্থাপনা ও পুরো শহরের পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা সম্ভব।
বনের টানে, পানির টানে
দ্বিতীয় দিনটি কাটানো যেতে পারে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়ক-সংলগ্ন পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। ওই দিন শুরুতেই জলাবন রাতারগুলে (সোয়াম ফরেস্ট) যাওয়া যায়। যদিও শুষ্ক মৌসুমের চেয়ে বর্ষাকালেই রাতারগুল ভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয়। তবে এখনকার রাতারগুলের দৃশ্যও কম আকর্ষণীয় নয়। নতুন নতুন পাতা গজাচ্ছে গাছগাছালিতে। হিজল-করচ আর সবুজে মোড়া গাছের মাঝখানে জলাশয়ে জমে থাকা পানির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে যান পর্যটকেরা।
রাতারগুলের অবস্থান গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এটি দেখা শেষ করেই ছুটে যাওয়া যেতে পার্শ্ববর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে। গরমের এই সময়ে এ স্থানটিতে পর্যটকেরা স্বস্তি খুঁজে পান। বিশেষত বিকেলে এখানকার আবহাওয়া বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জের শেষ সীমানায় সাদাপাথরের অবস্থান। সব মৌসুমেই সাদাপাথর পর্যটকদের আগ্রহের শীর্ষে থাকে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ভারত থেকে পাহাড়ের মাঝবরাবর ছুটে আসা শীতল পানির স্রোতধারা কলকল শব্দ তুলে বাংলাদেশে এসে পাথরের ওপর দিয়ে গড়িয়ে কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদে মিশছে। বর্ষা মৌসুম না হওয়ায় এখন পানি কম এলেও সৌন্দর্যে তেমন ভাটা পড়েনি। পর্যটকেরা পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল পানিতে গা এলিয়ে দেন আর তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করেন দূরের পাহাড়িয়া এলাকার সৌন্দর্যসুধা।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, কেউ চাইলে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা কার-মাইক্রোবাস ভাড়া করে ভোলাগঞ্জে আসতে পারেন। আবার সিলেট থেকে যাত্রীবাহী বাসও দিনভর চলাচল করে। সেসবেও আসা যায়। ভোলাগঞ্জে এসে নৌকা দিয়ে সাদাপাথরে যেতে হয়। পর্যটকদের ভোগান্তি দূর করতে স্থানীয় প্রশাসন নৌকা ভাড়া নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। রাতারগুলেও প্রশাসন নির্ধারিত নৌকাভাড়া রয়েছে।
পথে পথে সৌন্দর্য
সিলেট ভ্রমণের তৃতীয় দিনটি কাটাতে পারেন সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে। এ সড়কের ডানে-বামে যেন ছড়িয়ে আছে অপার সৌন্দর্য। সড়ক-সংলগ্ন জৈন্তাপুর উপজেলায় জৈন্তা রাজবাড়ি; দুই দিকের সুউচ্চ সবুজ পাহাড় আর নদের নীল পানির নদখ্যাত লালাখাল; উঁচুনিচু টিলা, চা-বাগান আর সারি সারি গাছের দৃষ্টিনন্দন শ্রীপুর পিকনিক স্পট; রাংপানি এবং গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং, মায়াবি ঝরনা ও ডাউকি নদীর তীরের খাসিয়াপল্লি ও পানপুঞ্জি অবস্থিত। এসব এক দিনেই দেখা সম্ভব।
স্থানীয় পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, যাত্রীবাহী বাসে সিলেট-তামাবিল আঞ্চলিক সড়কের আশপাশে অবস্থিত পর্যটনকেন্দ্রগুলো চলাচল করা সম্ভব। তবে সময়ের দিকে খেয়াল রেখে সব কটি পর্যটনকেন্দ্র নির্বিঘ্নে দেখার জন্য একটি মাইক্রোবাস বা সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করার পরিকল্পনা রাখা সবচেয়ে ভালো।
জাফলং যেতে জৈন্তাপুর উপজেলা সদর পাড়ি দেওয়ার পরই ডান দিকে ভারতের সীমান্ত এলাকার সারি সারি পাহাড়গুলো দেখা যায়। আকাশ একটু মেঘলা থাকলে কিংবা বৃষ্টি হলে পরিবেশ চমৎকার থাকে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের বুকে অসংখ্য ঝরনার সৃষ্টি হয়। সেসব ঝরনা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার নান্দনিক দৃশ্যও তখন দেখা যায়। জাফলংয়ের বিজিবি ক্যাম্পের টিলায় বসে সন্ধ্যাবেলা সীমান্তের ওপারে থাকা টিলাবেষ্টিত ডাউকি বাজারের বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জোনাকি পোকার মতো জ্বলজ্বল করে। এসব দেখতে অন্য রকম এক ভালোলাগার অনুভূতির সৃষ্টি হয় বলে একাধিক পর্যটক জানিয়েছেন।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, সিলেটে সবচেয়ে বেশি পর্যটনকেন্দ্র গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। জাফলং, রাতারগুল, বিছনাকান্দিসহ অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র এখানে। পর্যটকেরা যেন হয়রানির শিকার না হন—এ বিষয়ে সব কটি স্থানে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ট্যুরিস্ট পুলিশ, থানা-পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা তৎপর।