রংপুরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত ‘ত্যাগী’ বিএনপি কর্মী হয়ে গেলেন ‘জনৈক’

বিএনপিকর্মী লাভলু সরকারকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে মানবন্ধনে লাভলুর স্বজনরা। শনিবার দুপুরে রংপুরের বদরগঞ্জ-রংপুর সড়কের পাকারমাথা বাজারের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ৩১ জুলাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন রংপুরের বদরগঞ্জের লাভলু মিয়া। বদরগঞ্জ থানার পুলিশের নথিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি বিএনপির ১০ নম্বর মধুপুর ইউনিয়নের একজন সক্রিয় কর্মী। ৫ এপ্রিল বদরগঞ্জে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা যান সেই লাভলু মিয়া।

আরও পড়ুন

এ ঘটনায় সংঘর্ষে জড়ানো দুই পক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষে গত বুধবার মানহানির মামলা করেছেন রংপুর জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শফি কামাল। তাতে বিএনপির সক্রিয় কর্মী লাভলুকে ‘জনৈক একজন ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে নিয়ে জানা যায়, লাভলু মিয়া মধুপুর ইউনিয়ন বিএনপির সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। দলীয় পদে থাকা বিএনপির একজন কর্মীকে ‘জনৈক’ বলায় সংক্ষুব্ধ লাভলুর পরিবার ও দলের তৃণমূলের কর্মীরা।

বদরগঞ্জের বিএনপি নেতা–কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৩১ জুলাই লাভলু মিয়া গণ–অভ্যুত্থানে গ্রেপ্তার হলে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৭ আগস্ট কারাগার থেকে ছাড়া পান। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘রাতের ভোট’ ঠেকানোর নাশকতার মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে তিন মাস কারাগারে ছিলেন। এ ছাড়া লাভলু মিয়া শেখ হাসিনার সরকারের সময় কয়েকটি রাজনৈতিক মামলার আসামি হন এবং জেল খাটেন।

আরও পড়ুন

শফি কামালের মামলার আরজিতে বলা হয়, ‘আসামিগণ নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করিয়া কলহ বিবাদে জড়িত। সকল আসামিগণ (সঠিক হবে আসামি) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সম্মানিত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও বাংলাদেশের জনপ্রিয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির দলীয় সুনাম ক্ষুন্ন করিয়া মানহানিকর অপরাধ করিয়াছেন। আসামিগণ এবং তাহাদের দোসরদের উক্ত কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয় জনৈক লাভলু মিয়া নামক একজন ব্যক্তি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন।’

এই মামলায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় সদ্য বহিষ্কৃত জেলা বিএনপির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার, বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির, উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শহিদুল হক, পৌর যুবদলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক সুমন সরদার, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদুল হক, উপজেলার মধুপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক, কালুপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. গোলাম কিবরিয়াকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও দেড় শ জনকে।

নিহত লাভলু মিয়াকে ‘জনৈক’ বলা দুঃখজনক উল্লেখ করে তাঁর শ্যালক রিপন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোকটা (লাভলু মিয়া) এত কিছু করল, তিন থেকে চারবার জেল খাটল। তারপরও এখন বলে, আমার দুলাভাই কোনো কর্মী ছিল না। উনি বিএনপির ছিল না। কিছু যদি না হয়, তাহলে জেল খাটল কেন? এই কথাগুলো আসতেছে, আমার দুলাভাই নাকি কিছু না বিএনপির, এগুলো শুনে আমার ভাগনে (লাভলু মিয়ার ছেলে) হাউমাউ করে কান্না করতেছে।’

বদরগঞ্জ উপজেলা ও মধুপুর ইউনিয়ন বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাভলু মিয়া বিএনপির নিবেদিত কর্মী ছিলেন। মধুপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি মোকসেদুল হক সরকার প্রথম আলোকে বলেন, লাভলু মিয়া বিএনপির পদধারী নেতা ছিলেন। ২০১৮ সালে রাতের ভোট ঠেকাতে গিয়ে তিনি পুলিশের গুলিতে আহত হন।

তবে মামলার বাদী শফি কামাল দাবি করেন, বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালের নির্দেশে এবং জেলা কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের পরামর্শক্রমে এই মামলা করা হয়েছে। আরজিতে বিএনপির পদধারী একজন নেতাকে ‘জনৈক’ কেন বলা হলো—এমন প্রশ্নের উত্তরে শফি জামালের দাবি, তাঁরা ‘জনৈক’ বলেননি।

প্রথম আলোর হাতে মামলার আরজি আছে। সেখানে ‘জনৈক’ বলা আছে। এমন তথ্যের জবাবে শফি কামাল বলেন, এই মামলায় বদরগঞ্জ থেকে যাঁরা মামলার সাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁরা লাভলু মিয়া যে বিএনপির সঙ্গে জড়িত—এ তথ্য দেননি। যে কারণে দলীয় পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। তবে তাঁরা এখন খোঁজ নিচ্ছেন।

জেলা মহিলা দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শাহেদা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাভলু মিয়া বিএনপির একজন ত্যাগী নেতা ছিল। মধুপুর ইউনিয়ন বিএনপি বললে লাভলু মিয়ার নাম আসবে। অথচ আজকে একটি মানহানির মামলায় তাকে “জনৈক” বলা হয়েছে। আমাদের দুঃখ, ৫ এপ্রিলের ঘটনার চার দিন পর মানহানির মামলা হলো। এই চার দিনেও কি তার (লাভলু মিয়া) দলীয় পরিচয় জানা যায়নি? লাভলু উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক পরিতোষ চক্রবর্তীর কাছে থেকে রাজনীতি করেছেন। তার দলীয় পরিচয় তুলে ধরা হলো না কেন?’

এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক পরিতোষ চক্রবর্তী দাবি করেন, তিনি মামলার আরজি দেখেননি। কেন্দ্রের নির্দেশে জেলা থেকে মামলা হয়েছে। মামলার বিষয়েরও তাঁর সঙ্গে কারও কথা হয়নি।

এদিকে লাভলু মিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে মধুপুরে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় লোকজন ও নিহত ব্যক্তির পরিবার। মানববন্ধনে লাভলু মিয়ার ছেলে রায়হান কবির সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর বাবা বিএনপির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। যাঁরা আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্ত, (বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল হক মানিকের নাম বলেন), এখন বিএনপির নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছেন, তাঁরাই তাঁর বাবাকে হত্যা করেছেন। রায়হান কবির তাঁর বাবাকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন।