‘কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়’

শত শত বছর ধরে স্থপতি বাবুই পাখির আশ্রয় হয়ে আছে তালগাছছবি: প্রথম আলো

একদিকে টলটলে জলের পুকুর। মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ তুলে তিরতির করে কাঁপছে। অন্য পাশে গ্রামীণ সড়ক চলে গেছে। সঙ্গে কিছু কলাগাছ, বুনো গাছ নিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে তালগাছটি। এ এক চিরায়ত লোকজ গ্রামীণ চেনা চেহারা। তালগাছ এখন অনেকটা কমে গেছে, তারপরও গ্রাম থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি। এখনো গ্রামের কোনো পুকুর বা দীঘির পাড়ে, পথের পাশে দু-একটা তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকে।

শত শত বছর ধরে স্থপতি বাবুই পাখির আশ্রয় হয়ে আছে তালগাছ। এখন অনেকটা বিলুপ্তির দিকে থাকলেও তালগাছের পাতা বাবুই পাখির পরিচিত মাতৃকোল। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর গ্রামে এ রকম একটি তালগাছ এখন বাবুই পাখির বাসায় ভরে উঠেছে, যা আলাদাভাবে অনেকের নজর কাড়ছে।

গয়ঘর গ্রামের মো. আমির জানান, তাঁদের গ্রামের একটি তালগাছে বাবুই পাখি বাসা করেছে। অনেকগুলো বাসা। বাবুই পাখি তালগাছে বাসা বোনে, এটা গ্রামীণ প্রকৃতির একটি সহজাত অংশ। এটা আলাদা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু দিনে দিনে তালগাছ কমে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু তালগাছ থাকলেও সবখানে এখন আর এই পাখির চোখজুড়ানো বাসা খুব একটা চোখে পড়ে না।

বাসা বানায় পুরুষ বাবুই পাখি
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি এক বিকেলে গয়ঘর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, একটি বাড়ির পুকুরপাড়ে গ্রামীণ সড়কের পাশ ঘেঁষে আকাশের মেঘ ফুঁড়তেই যেন দাঁড়িয়ে আছে তালগাছটি। তালগাছের বিভিন্ন পাতায় বাসা বুনেছে স্থপতি পাখি বাবুই। একটা নয়, অনেকটা। কোনো বাসা বোনার কাজ শেষ হয়ে গেছে, কোনোটি তখনো বোনা চলছে। ততক্ষণে বিকেলটা সন্ধ্যার দিকে ঝুঁকে গেছে। তখন বনবাদাড়ের খোলা প্রান্তর থেকে পাখিদের ফেরার সময় হয়েছে। ধীরে ধীরে এক–দুটো করে বাবুই ফিরে আসছে। কোনোটি বাসার ওপরে বসছে, কোনোটি বাসার ভেতরে ঢুকে কিছু একটা পরখ করছে। এক বাসা থেকে আরেকটিতে উড়ে যাচ্ছে। কোনোটা পাতার ওপর বসে চারদিকটা দেখে নিচ্ছে। আবার তালগাছ ছেড়ে আশপাশের কোনো গাছে গিয়ে বসছে, আবার ফিরে আসছে। সে এক চঞ্চল মুহূর্ত।

এ দেশে এত সুন্দর করে হয়তো বাবুই পাখিই এমন বাসা বুনে থাকে। বাসার সবকিছুতে লেগে আছে শিল্পীর কারিগরি কুশলতা, শিল্পমাধুর্য। দেখতে জটিল বুনন, কিন্তু কত সহজ করেই বুনে ফেলে বাবুই!

বাবুই পাখির আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর
ছবি: প্রথম আলো

গ্রীষ্মকাল হচ্ছে বাবুই পাখির প্রজনন ঋতু। এ সময় স্থপতি পুরুষেরা কচি তাল, খেজুর, ধান ও ঘাসপাতা থেকে বাসা তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। সুতার মতো দু-তিন ফুট লম্বা পাতার চিকন আঁশ ঠোঁটে চেপে নিয়ে আসে। পছন্দের গাছের ডালে সেটা পেঁচিয়ে গিঁট দেয়, বাসা বুনতে শুরু করে। সুচালো ঠোঁটে পাতা ফুটো করে সেলাইয়ের মতো ফোঁড়ের পর ফোঁড় দিয়ে বাসা বুনে তোলে। বাসার অর্ধেকটা তৈরি হয়ে গেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে স্ত্রী বাবুই আসতে থাকে। একটি বাসা তৈরিতে সময় লাগে ৭ থেকে ১০ দিন। স্ত্রী বাবুই গড়ে তিনটি ডিম পেড়ে থাকে। ডিম থেকে ছানা ফুটতে ১০ থেকে ১৩ দিন সময় লাগে। ছানারা ১৫ থেকে ১৯ দিনে উড়তে শেখে। বাবুই পাখির আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় বাবুই পাখির দেখা মেলে।

স্ত্রী বাবুই গড়ে তিনটি ডিম পেড়ে থাকে। ডিম থেকে ছানা ফুটতে ১০ থেকে ১৩ দিন সময় লাগে
ছবি: প্রথম আলো

গয়ঘরের আরেকটি বাড়ির পুকুরপাড়ের তালগাছে দেখা গেল, আরও কিছু বাবুই নতুন করে বাসা বুনছে। সন্ধ্যা ঘন হয়ে এসেছে। চারদিক অন্ধকার করে রাত্রি নামছে। তালগাছে বাবুই পাখির এতক্ষণ ধরে চলা কিচকিচ শব্দ কমতে থাকে। একটা সময় পাখির ডাক থেমে যায়। বাবুই পাখির এ রকম বাসা দেখেই হয়তো ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতাটি লিখেছিলেন কবি রজনীকান্ত সেন। কবিতাটি এমন, ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই/ কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই...বাবুই হাসিয়া কহে, সন্দেহ কি তায়?/ কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।’ হয়তো অন্য কেউ নয়, স্থপতি পাখিটি জানে তালগাছে নিজের শ্রমে-আনন্দে তৈরি নিজের ঘরের সুখ।