মৌলভীবাজারে বন–পাহাড়ের দুর্লভ ফুল ‘কুরচি’
গাছটির কাছে গেলেই হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো অচেনা সুগন্ধ মনকে ফুলমুখী করে তুলে, অনেকটা আচ্ছন্ন করে ফেলে। ‘দাঁড়াও পথিকবর’...এ রকমই পথ আগলে দাঁড়ায় যেন এই ফুলের ঘ্রাণ, ফুলের চোখ খোলা রূপবতী পাপড়ি, পালক। গাছটি খুব বড় নয়। তার ডালে ডালে সবুজ পাতাকে ছাপিয়ে থোকায় থোকায় দুধরঙা সাদা ফুল ফুটে আছে। সব জঞ্জালকে দূরে ঠেলে সবুজে-সাদায় মিলে এ এক শান্ত, স্নিগ্ধ মুহূর্ত গাছটির কাছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকেই বলেছিলেন, ‘কুরচি, তোমার লাগি পদ্মেরে ভুলেছে অন্যমনা...।’ বন–পাহাড়ের এই দুর্লভ ফুল ‘কুরচি’। ফুলটি আনমনে ফুটেছে মৌলভীবাজার শহরের কাছে শান্তিবাগ ওয়াকওয়েতে। হঠাৎ করেই চোখ কেড়ে নেয় এই ফুল। ফুলটির সঙ্গে পরিচয় না ঘটলেও নামটি অনেকের কাছে চেনা মনে হতে পারে। এর কারণও আছে, গাছটি দেশজ ও সংস্কৃতিকাব্যে বহুল উল্লেখ করা একটি ফুল।
শান্তিবাগ ওয়াকওয়েতে বেশ কিছুদিন থেকে গাছটিতে ফুল আসছে। ধীরে ধীরে কিছু সাদা ফুল ফুটছে। তবে এই কদিনে একদম ঝাঁপিয়ে ফুটেছে ফুল। রোববার সকালে ওয়াকওয়েতে গিয়ে দেখা গেছে, ক্ষুদ্র আকারের গাছটিতে লম্বাটে, সবুজ পাতাকে ছাপিয়ে দুধরঙা অনেক ফুল শাখাপ্রশাখায় ফুটে আছে। গাছের পুরাটাই ফুলে ফুলে ভরে গেছে। ঊর্ধ্বমুখী ও এলোমেলো ডালগুলোতে ফুলের ঝাঁপি খুলে দিয়েছে কেউ। গ্রীষ্মের শুরুতে কেমন যেন আকাশের মেঘকে ডাকছে এই ফুল!
এখানে শরীরচর্চা করতে আসা বিকাশ ভৌমিক কিছুদিন আগে একটি গাছে অনেকগুলো সাদা ফুল ফোটার কথা জানিয়েছিলেন। গাছটির কাছে গেলেই সুতীব্র, মিঠে ঘ্রাণ মনকে আচ্ছন্ন করে। অনেকটা দূর পর্যন্ত সেই মধুগন্ধ ছড়িয়ে আছে। গাছের নিচে সবুজ ঘাসের ওপর পাপড়ি ঝরে পড়ছে। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে সাদা সাদা পাপড়িদল। মৌলভীবাজার শহরে এর আগে এ রকম ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকা কুরচির গাছ আছে, জানা যায়নি। চোখে পড়েনি।
নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে কুরচি সম্পর্কে জানিয়েছেন, পলাশ ও শিমুলের রং যখন ঝরে যায়, তরুর ভীরু সবুজ চৈত্রের রোষে সংকুচিত হয়, কৃষ্ণচূড়ার কলিরা থাকে শাখার গভীরে ঘুমিয়ে। তখন কুরচিই কেবল প্রকৃতির বর্ণসুষমার ঘোষক হয়ে ওঠে। এই গাছের আদি আবাস বাংলা, ভারত ও ব্রহ্মদেশ। স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে গাছটির আলাদা বৈশিষ্ট্য অনেকেই লক্ষ করেন না। কুরচি পাহাড়ে প্রচুর জন্মালেও আবাসিক এলাকায় দুষ্প্রাপ্য।
কুরচির মঞ্জরিতে ফুলের সংখ্যা কম হলেও বিক্ষিপ্ত মঞ্জরির সংখ্যা অজস্র। ফুল অনেকটা রঙ্গন ফুলের মতো দেখতে; নিচের অংশ নলাকৃতি এবং ওপর পাপড়িতে ছড়ানো। কুরচি ভেষজমূল্যে সমৃদ্ধ।
প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন বলেন, ‘কুরচি আমাদের বন–পাহাড়ের দুর্লভ ফুল। শুভ্রতা ও সুগন্ধের জন্য এ ফুল বিখ্যাত। নগরে সৌন্দর্য রচনায় এই ফুলের বীথিবদ্ধ আয়োজন থাকা দরকার।’