চট্টগ্রামে ডুবে যাওয়া লাইটার জাহাজটির ৯ নাবিকের ৮ জনের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুরে
চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে লাইটার জাহাজডুবির ঘটনায় উদ্ধার হওয়া চার মরদেহের মধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করেছেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের তিনজনের বাড়িই মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায়। আজ শুক্রবার ভোররাত থেকে দুপুরের মধ্যে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী এসব মরদেহ উদ্ধার করে।
গত বুধবার দুর্ঘটনার পরপরই তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। তাঁদের মধ্যে দুজনের বাড়িও এই মহম্মদপুর উপজেলায়। বেঁচে ফেরা একজনের পরিচয় এখনো জানাতে পারেনি কোনো সূত্র।
কোস্টগার্ড সূত্রে জানা গেছে, ডুবে যাওয়া লাইটার জাহাজ এমভি সুলতান সানজানায় ওই দিন মোট নয়জন নাবিক ছিলেন। বেঁচে ফেরা তিনজন এবং লাশ উদ্ধার হওয়া চারজনকে বাদ দিলে এই নৌ দুর্ঘটনায় এখন দুজন নিখোঁজ রয়েছেন।
এদিকে ডুবে যাওয়া জাহাজটিতে যে নয়জন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আটজনের বাড়িই মাগুরার মহম্মদপুর বলে নিশ্চিত করেছেন পরিবারের সদস্যরা। জীবিত দুজন ও মৃত তিনজনের বাইরে মাগুরার আরও তিনজনের নাম জানা গেছে, যাঁরা বর্তমানে নিখোঁজ। এই তিনজন ওই জাহাজডুবির পর থেকে এখনো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
লাশ উদ্ধার হওয়া চারজন হলেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের মণ্ডলগাতি গ্রামের খসরু বিশ্বাসের ছেলে সুরুজ মিয়া (২২), একই গ্রামের নুরোল মোল্লার ছেলে জাহিদুল ইসলাম (২৯) ও বাবুখালী ইউনিয়নের দাতিয়াদাহ গ্রামের আকরাম হোসেনের ছেলে নাজমুল হাসান (২৭)। উদ্ধার হওয়ার চতুর্থ লাশটির পরিচয় এখনো জানা যায়নি। কোস্টগার্ডের পূর্ব জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কাজী আল আমিন প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জীবিত তিনজনের মধ্যে যে দুজনের পরিচয় জানা গেছে তাঁরা হলেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের যশোবন্তপুর গ্রামের রুবেল এবং একই উপজেলার নহাটা ইউনিয়নের খলিসাখালী গ্রামের কামাল মোল্যার ছেলে রবিউল ইসলাম।
নিখোঁজ থাকা মাগুরার অপর তিনজন হলেন মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের মণ্ডলগাতি গ্রামের নুরোল হোসেন মোল্যার ছেলে শিমুল মোল্লা (মৃত জাহিদুলের ভাই), একই গ্রামের গোলাম রসূল মোল্যার ছেলে নূর মোহাম্মদ ও নহাটা ইউনিয়নের খলিসাখালী গ্রামের কামাল মোল্যার ছেলে মনির হোসেন।
বুধবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পাথরবোঝাই করে নয়জন নাবিক নিয়ে ফিরছিল এমভি সুলতান সানজানা জাহাজ। পথে আরেকটি লাইটার জাহাজ এমভি আকিজ লজিস্টিকস-২৩-এর সঙ্গে সংঘর্ষে এমভি সুলতান সানজানা ডুবে যায়। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের পাঁচজন, নহাটা ইউনিয়নের দুজন ও বাবুখালী ইউনিয়নের একজন নাবিক ছিলেন এমভি সুলতান সানজানা জাহাজটিতে।
মহম্মদপুরে চলছে মাতম
আজ সকালে মহম্মদপুরে নিহত ও নিখোঁজ নাবিকদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারগুলোতে চলছে স্বজন হারানোর মাতম। বাবুখালী ইউনিয়নের দাতিয়াদাহ গ্রামে মারা যাওয়া নাজমুলের পরিবারের লোকজন জানান, মাত্র ১০ দিন আগে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাড়িতে এসেছিলেন নাজমুল। অনুষ্ঠান শেষে চট্টগ্রামে জাহাজে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি। গেলেন, কিন্তু আর কোনো দিন ফিরবেন না তিনি।
পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের মণ্ডলগাতি গ্রামের দুই ভাই শিমুল ও জাহিদুল এমভি সুলতান সানজানায় ছিলেন সেদিন। এর মধ্যে জাহিদুলের লাশ উদ্ধার হয়েছে। শিমুল নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের মা ফাতেমা বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘আমার ছেলেরা বুধবার সকালে মুঠোফোনে কথা বলে কাজে গেছে। পরে কথা বলবে জানালেও আর কথা হয়নি। এখন শুনছি, তাদের জাহাজ ডুবে গেছে। লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। এই শোক আমি কীভাবে সহ্য করব...।’
শিমুল-জাহিদুলের সঙ্গেই চাকরি করতেন একই গ্রামের হাসান মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমি ছুটিতে আছি। কাজে যোগদান করব কদিন পর। শিমুল ও তাঁর ভাই জাহিদুল দেড় বছর হলো কাজ শুরু করেছে। এমন দুর্ঘটনা আমার ছয় বছরের কাজের জীবনে দেখিনি।’
নহাটা ইউনিয়নের খলিসাখালী গ্রামের দুই সহোদর মনির ও রবিউলও ছিলেন ওই জাহাজে। তাঁদের ফুফু নাজমা আক্তার বলেন, ‘রবিউল বেঁচে ফিরলেও মনির ফেরেনি (নিখোঁজ)। এই জানুয়ারি মাসে মনিরের জন্য মেয়ে দেখার কথা। আমাদের কত স্বপ্ন ছিল, ওর বিয়েতে আমরা আনন্দ করব। আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।’
পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের যশোবন্তপুর গ্রামের রুবেল ডুবে যাওয়া জাহাজটি থেকে বেঁচে ফিরেছেন। রুবেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পাথর নিয়ে জাহাজে করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পেছন থেকে অন্য জাহাজ আঘাত করে। সে সময় আমাদের জাহাজে মাগুরার মোট আটজন ছিল। আমার সঙ্গে রবিউল কূলে উঠলেও অন্যদের দেখা পাইনি।’
পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও মণ্ডলগাতি গ্রামের বাসিন্দা আবদুর সবুর বলেন, ‘আমাদের গ্রামের শতাধিক মানুষ চিটাগাং এলাকায় জাহাজ ও ট্রলারে কাজ করে। কখনো এমন হয়নি। যারা নিখোঁজ রয়েছে, তাদের বেঁচে ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছে পরিবারের সদস্যরা। তবে মরদেহটি পেলে আমরা অন্তত কবরটা দিতে পারি।’
এদিকে নিখোঁজ বা নিহত ব্যক্তিদের বিষয়ে কোনো তথ্য জানে না জেলা পুলিশ ও প্রশাসন। জানতে চাইলে মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কলিমুল্লাহ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণমাধ্যম থেকে খবর জানতে পেরেছি। গোয়েন্দা শাখাকে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে।’
মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রামানন্দ পাল প্রথম আলোকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে জাহাজডুবির ঘটনায় মাগুরার কেউ সেখানে কর্মরত ছিলেন কিংবা এমন কেউ নিখোঁজ বা লাশ উদ্ধারের কোনো তথ্য অফিশিয়ালি আমাদের কাছে নেই। তবে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে। স্থানীয়ভাবে নিখোঁজ বলে যাঁদের কথা জানা যাচ্ছে, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’