অভয়াশ্রম আবারও চালু করতে গত মে মাসে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদীতে
ছবি: প্রথম আলো

প্রাণ ফিরে পেতে চলেছে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদীতে মাছের অভয়াশ্রমটি। পরিকল্পনাহীনতা ও উদ্যোগের অভাবে এটি প্রায় বিলুপ্তি হতে বসেছিল।

বিলুপ্তপ্রায় দেশি প্রজাতির বিভিন্ন মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ২০০৩ সালে চিত্রা নদীতে গড়ে তোলা হয়েছিল মাছের এ অভয়াশ্রম। এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নদীর দুই পারে বসবাসকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে গঠন করা হয়েছিল ‘চিত্রা নদী উন্নয়ন সমিতি’। দেশি প্রজাতির মাছের প্রজননে অভয়াশ্রমটিতে সাফল্যও এসেছিল ঢের। কিন্তু পরিকল্পনাহীনতা ও উদ্যোগের অভাব এবং সমিতির কর্মকর্তাদের নামে একটি ‘মিথ্যা মামলায়’ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মিষ্টিপানির সবচেয়ে বড় অভয়াশ্রমটি।

অভয়াশ্রমটি চালু করতে চলতি বছরের মে মাস থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে বাঘারপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পলাশ বালা বলেন, ‘দেশি প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের জন্য অভয়াশ্রমটি আবারও চালু করা হয়েছে। প্রথম দফায় ২৪ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ টাকা দিয়ে অভয়াশ্রমের কচুরিপানা পরিষ্কার, বাঁশ পোঁতা ও গাছের ডালপালা দেওয়া হয়েছে। চারপাশে বাঁশ দিয়ে এমনভাবে ঘেরা হয়েছে যে অভয়াশ্রমের ভেতরে ঢুকে কেউ মাছ ধরতে পারবে না। আশা করছি, অভয়াশ্রমটিতে দ্রুত দেশি প্রজাতির মাছের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে।’

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, বাঘারপাড়া থানার পাশে চিত্রা নদীর বাঁকে মাছের অভয়াশ্রম চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। অভয়াশ্রমের মধ্যে গাছের ডালপালা দেওয়া হয়েছে। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দোহাকুলা গ্রামের বাসিন্দা মুস্তাক হোসেন বলেন, অভয়াশ্রমে প্রচুর শোল, বোয়াল, পাবদা, শিং, মাগুর, টেংরাসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ রয়েছে। বর্ষায় ডিম ছাড়লে তা ছড়িয়ে পড়বে আশপাশের এলাকায়। কয়েক বছর পর অভয়াশ্রমটিতে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রাচুর্য দেখা যাচ্ছে। এলাকার মানুষ সচেতন হলে এ অভয়াশ্রম থেকে সুফল আসবে।

একই গ্রামের মৎস্যজীবী খোকন বিশ্বাস বলেন, চিত্রা নদীর অভয়াশ্রমটি একসময় খুব ভালো ছিল। শুষ্ক মৌসুমে মাছ সহজে অভয়াশ্রমে আশ্রয় নিত। আবার প্রজনন মৌসুমে নির্বিঘ্নে খালে-বিলে গিয়ে বংশ বিস্তার করত। কয়েক বছর অভয়াশ্রম সেইভাবে ছিল না। এতে দেশি প্রজাতির মাছের উৎপাদনও কমে গিয়েছিল। নতুন করে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে অভয়াশ্রমটি প্রাণ ফিরে পাবে।

বাঘারপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের জন্য শুষ্ক মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও প্রজনন মৌসুমে বিচরণক্ষেত্র তৈরির জন্য ২০০৩ সালে এ অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়। মৎস্য অধিদপ্তর, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টার’ ও বেসরকারি সংগঠন ‘বাঁচতে শেখা’ যৌথভাবে এ উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পের মোট আয়তন ছিল চিত্রা নদীর ১১৮ হেক্টর এলাকা। এর মধ্যে নদীর গভীর ও প্রশস্ত অংশ বাঘারপাড়া থানার পাশের ৪ দশমিক শূন্য ৫ হেক্টর এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাকি অংশ মাছ ধরার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। স্থানীয় বিল জলেশ্বর থেকে ধলগ্রাম জলকপাট পর্যন্ত নদীর দুই পারে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে গঠন
করা হয় ‘চিত্রা নদী উন্নয়ন সমিতি’। সমিতির সুফলভোগী ছিলেন ৪৩৫ জন। সমিতির কর্মকাণ্ড ছিল অভয়াশ্রম রক্ষণাবেক্ষণ, প্রকল্পভুক্ত এলাকায় আড়বাঁধ ও কারেন্ট জাল উচ্ছেদ এবং কচুরিপানা পরিষ্কার। অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যে সাফল্য পাওয়া যায়।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই স্থানীয় চেঁচুয়াখোলা গ্রামের এক নারী সমিতির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর পর থেকে সমিতির কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করে। এর মধ্যে ‘ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টার’ ও ‘বাঁচতে শেখা’ তাদের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয়। মৎস্য অধিদপ্তরও অভয়াশ্রমটি নিয়ে আর আগ্রহ দেখায়নি। ফলে ২০০৯ সালের দিকে পুরো কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অভয়াশ্রমটি ভরে যায় কচুরিপানায়। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ওই মামলার রায় হয়। আসামিদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। কিন্তু অভয়াশ্রমটি সংরক্ষণে তখন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চলতি বছরের মে মাস থেকে আবারও অভয়াশ্রমটি সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়।