কালুরঘাটে ট্রেন দুর্ঘটনা: মেয়ের কুলখানির দিনও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে সাজ্জাদুন
‘হঠাৎ এক ঝড় এসে আমার সাজানো পরিবারটা তছনছ করে দিল। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কথা ছিল ঈদের দিন মেয়েটা ছোটাছুটি করবে। স্ত্রী নিজের হাতে রান্না করবে। কিন্তু কিছুই হলো না। মেয়েটা চলে যাওয়ার চার দিন পূর্ণ হলো আজ। এদিনেও স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে বসে আছি।’
কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাজ্জাদুন নূর। আজ সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে বসে স্ত্রী জুবাইরা ইসরার চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সেখানেই প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। আজ ছিল তাঁদের একমাত্র কন্যা মেহেরিমা নূর আয়েশার (৪) কুলখানি। কিন্তু এই দিনও স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে সাজ্জাদুনের।
৫ জুন রাতে ঈদের ছুটি কাটাতে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন সাজ্জাদুন। কালুরঘাট সেতুর পূর্ব প্রান্তে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা অবস্থায় কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় তাঁদের গাড়িটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই নিহত হয় আয়েশা। স্ত্রীর এক পা থেঁতলে যায়। সাজ্জাদুন নিজেও ডান পায়ে আঘাত পান। অটোরিকশাচালক তৌহিদুল ইসলামও মারা যান।
সাজ্জাদুনদের বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব গোমদণ্ডী মুন্সিপাড়া এলাকায়। থাকতেন চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকার ভাড়া বাসায়।
সাজ্জাদুন বলেন, ‘বাসার নিচ থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করেছিলাম। মোহরা এলাকায় গিয়ে অটোরিকশাটি অচল হয়ে যায়। পরে সেখান থেকে আরেকটি অটোরিকশা ঠিক করি।’
এরপর যা ঘটেছে, তা বলতে গিয়ে গলা শুকিয়ে আসছিল সাজ্জাদুনের। তারপরও নিজেকে সামলে তিনি বলেন, ‘গাড়িগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিল। অপর প্রান্ত থেকে তখন ট্রেন আসার শব্দ পাই। ইঞ্জিনের সামনে থাকা বাতির আলো চোখে পড়ছিল আমাদের। দেখলাম, সামনে থাকা টেম্পোটা আগের অটোরিকশাটি অতিক্রম করে দ্রুত চলে গেল। এমন সময়ে ট্রেন কাছাকাছি চলে এল।’
সাজ্জাদুন আরও বলেন, ‘ট্রেন এসে পাশে সজোরে ধাক্কা দেয়। অটোরিকশা ঘুরে যায়। আবার ধাক্কা দেয়। টেনে কিছুদূর নিয়ে যায়। মেয়েটার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। রক্ত ঝরতে থাকে। স্ত্রীর ডান পায়ের বিভিন্ন অংশ ছিঁড়ে যায়। পায়ের নখ উঠে যায়। পায়ের পাতাও থেঁতলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করেন।’
শহরের ভাড়া বাসায় প্রতিটি কোণায় ছোট্ট আয়েশার স্মৃতি। সাজ্জাদুন বলেন, ‘এ ঘরে আর থাকতে পারব না। ঢুকলেই মেয়ের কথা মনে পড়ে। যখন মেয়ের অসুখ হতো, আমি কপালে চুমু দিতাম। সে ভালো হয়ে যেত। সেদিন অনেক চুমু দিয়েছি, কিন্তু সে আর উঠল না।’
পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার সাজ্জাদুন একটি বেসরকারি আইটি ফার্মে চাকরি করেন। স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বলেন, ‘সংসার টানাটানির মধ্যে চলে। এর মধ্যে চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে আরও কষ্টে পড়েছি। কেউ সহযোগিতা করলে কিছুটা উপকার হতো।’
দুর্ঘটনার কারণ
জাহান আলী রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার নেজাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, পর্যটক এক্সপ্রেস রাত ১০টার দিকে কালুরঘাট সেতুতে পৌঁছে। সেতুর ওপর তখন কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ছিল। একটি গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়ে অন্যগুলো আটকে ছিল।
নিয়ম অনুযায়ী ট্রেনচালককে সেতুর পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে ডেড স্টপ বইতে সই করে লাইনম্যানের সংকেত নিয়ে সেতুতে উঠতে হয়। কিন্তু ট্রেনচালক এই নিয়ম মানেননি। দ্রুতগতিতে সেতুতে উঠে যান। গতি ছিল ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। অথচ সর্বোচ্চ গতি হওয়া উচিত ছিল ১০ কিলোমিটার। এ কারণে চালক দায় এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন স্টেশনমাস্টার।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের গার্ড সোহেল রানা, লোকোমাস্টার গোলাম রসুল, সহকারী লোকোমাস্টার আমিন উল্লাহ এবং অস্থায়ী গেটকিপার মো. মাহবুবকে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে পর্যটক এক্সপ্রেসে কর্মরত অনেকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। ছুটি শেষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।