অগ্নিকাণ্ডে সব হারা রোহিঙ্গারা মাথা গোঁজার ঠাঁই চায়
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে গত রোববার রাতে পুড়ে ছাই হয় কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১১) ডি ব্লকের রোহিঙ্গা হাসিনা বেগমের ঘর। এরপর ধ্বংসস্তূপের পাশে পাহাড়ি ঢালুতে দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন তিনি। আজ সোমবার সকালে কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে হাসিনাও আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপে বসে নিজের ঘরের চিহ্ন (জায়গা) ঠিক করেন। তারপর সেখানে অবস্থান নিতে থাকেন।
হাসিনা বেগম বলেন, ‘আকাশর নিচত ( নিচে) থাহা নজার। অঁইনত (আগুনে) হক্কল ছামানা (সব মালামাল) পুড়ি গিয়ে গই। এক কাপরত হনমতে (কোনোমতে) গরত্থুন (ঘর থেকে) বাইর আইত পাইজ্জি। এহন মাথা গুজাইবার একখান ঠিহানা দরহার।’
ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরের পাহাড়ি ঢালুতে গড়ে ওঠে রোহিঙ্গা বসতির ডি ব্লক।
গতকাল রোববার বিকেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই ডি ব্লকের অন্তত ৭০০টি ঘর (ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত শেল্টার) পুড়ে ছাই হয়েছে। একই সময় আশ্রয়শিবিরের এ এবং বি ব্লকের আরও ১ হাজার ৪০০টির মতো রোহিঙ্গা শেল্টার ভস্মীভূত হয়েছে। তিনটি ব্লকের অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
ধ্বংসস্তূপে হাসিনার পাশে বসেছিলেন আরেক রোহিঙ্গা নারী আয়েশা বেগম। রোববারের অগ্নিকাণ্ডে তাঁর ঘরটিও পুড়েছে। তিনিও এক কাপড়ে ঘর ছাড়েন। আয়েশা বেগম (৪০) বলেন, ঘটনার পর থেকে আজ বেলা ১১টা পর্যন্ত মুখে কিছু দিতে পারেননি। নগদ টাকাগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির ডব্লিউএফপির ত্রাণ কার্ডটিও আগুনে পুড়ে গেছে। এত দিন এই কার্ড দেখিয়ে দোকান থেকে মালামাল কিনতেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গৃহহীন কয়েক শ রোহিঙ্গা পরিবার রাতেই অবস্থান নেয় ধ্বংসস্তূপের পাশে খোলা জায়গায়। কিছু রোহিঙ্গা পাশের একটি পাহাড়ের ঢালুতে রোহিঙ্গা বসতিতে অবস্থান করছেন। কয়েক শ রোহিঙ্গার ঠাঁই হয়েছে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে একটি ট্রানজিট কেন্দ্রে।
ধ্বংসস্তূপের একটু দূরে খোলা মাঠে ত্রিপলের ছাউনি টাঙিয়ে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে অবস্থান করছেন রোহিঙ্গা আবদুল মজিদ। সন্তানেরা ছাউনির পাশে একটি গাছের নিচে বসে আছে। আবদুল মজিদ (৪৫) বললেন, প্রায়ই তাঁদের আগুন আর গোলাগুলির আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলিতে প্রায়ই হতাহতের ঘটনা ঘটছে। চলছে আগুন লাগিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চক্রান্ত। সাড়ে পাঁচ বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে পড়ে আছেন, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার লক্ষণ নেই। আতঙ্ক নিয়ে পাহাড়ের এই আশ্রয়শিবিরে কত দিন থাকতে হবে কারও জানা নেই।
বালুখালী আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা কামাল উদ্দিন বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার ঘর হলেও অগ্নিকাণ্ড, খুনখারাবির ঘটনা বেশি ঘটছে উখিয়ার বালুখালীতে গড়ে তোলা চারটি আশ্রয়শিবিরে। এগুলো হচ্ছে ক্যাম্প-৮, ৯, ১০ ও ১১। এই চারটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা থাকেন দুই লাখের বেশি। গত এক বছরে অন্তত ৫০ দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কোনোটির তদন্ত হয়নি।
দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীর তিনটি আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮, ৯ ও ১১) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছিল। গৃহহীন হয়েছিল ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। অগ্নিকাণ্ডে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ছয় শিশুসহ ১৫ রোহিঙ্গা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, বালুখালীর চারটি ক্যাম্পে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্য এবং মিয়ানমার থেকে মাদক (ইয়াবা ও আইস) চোরাচালানের অন্যতম হোতা নবী হোসেন বাহিনীর আস্তানা রয়েছে। বাহিনীর প্রধান রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন কয়েক মাস ধরে আত্মগোপনে। আরএসও এবং নবী হোসেন বাহিনীর সঙ্গে বিরোধ রয়েছে মিয়ানমারের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা)। আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারে আরসা বারবার বালুখালীর ক্যাম্পগুলোতে আক্রমণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি আগুন দিয়ে প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর আস্তানা ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, রোববার বালুখালীর আশ্রয়শিবিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল সাধারণ রোহিঙ্গারা। ঘটনার দুই দিন আগে আশ্রয়শিবিরে একটি অডিও ভাইরাল হয়। সেখানে আশ্রয়শিবিরে আগুন লাগানোর কথা বলা হয়। রোববার বিকেলে ভাইরাল হয় আরেকটি ভিডিও। ভিডিওতে কিছু রোহিঙ্গাকে আশ্রয়শিবিরের ঘরে আগুন লাগাতে দেখা গেছে। দুটি অডিও-ভিডিও প্রচার করে আরসা। তাতেই অনেকে ধরে নেয়, ঘটনা পরিকল্পিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, অগ্নিকাণ্ড–সংশ্লিষ্ট ভাইরাল ভিডিও চোখে পড়েছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।
সোমবার সকালে বালুখালীর আশ্রয়শিবির ঘুরে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে গৃহহীন পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপ দেখতে ছুটে আসছেন আশপাশের আশ্রয়শিবিরের শত শত রোহিঙ্গা। কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপ থেকে পুড়ে যাওয়া মালামাল সরিয়ে নিচ্ছেন।
জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারের বেশি ঘর (শেল্টার) পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। ক্যাম্প-১১ আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা থাকেন ৩২ হাজার ২০০ জন। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৯০টির বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লার্নিং সেন্টার, ত্রাণকেন্দ্রসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান। ৯ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা।