১১ বছরেও ফেরেনি ছেলে

২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে সাভার থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বাস থেকে তুলে নেওয়া হয় আল মুকাদ্দাসকে।

আল মুকাদ্দাস হোসেন

কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল মুকাদ্দাস হোসেন ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বাসে কুষ্টিয়া যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়েছিলেন। দুই দিন পর পরিবারের সদস্যরা তাঁর নিখোঁজের খবর জানতে পারেন। এর পর থেকে মুকাদ্দাসের সন্ধানে নানা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় পরিবার। গত ১১ বছরেও সন্ধান মেলেনি তাঁর।

আল মুকাদ্দাস পিরোজপুর সদর উপজেলার খানাকুনিয়ারি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক আবদুল হালিমের ছেলে। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ ও আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ২০২১ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারকে গুমের শিকার ৭৬ জনের তালিকা দেয়। ওই তালিকায় মুকাদ্দাসের নাম রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাঁকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি পরে জানতে পারে তাঁর পরিবার। এরপর ওই বছরই বারবার পুলিশ, র‌্যাবসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও আল মুকাদ্দাসের সন্ধান পায়নি তাঁর পরিবার। এ কারণে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে বন্দী প্রদর্শন রিট করা হয়। কিন্তু মুকাদ্দাস নিখোঁজের ব্যাপারে আদালতকে কোনো সন্ধান দিতে পারেনি প্রশাসন। এরপর আদালত কয়েকটি পর্যবেক্ষণসহ রিটটি খারিজ করে দেন।

আজ ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। মুকাদ্দাসের মা আয়শা সিদ্দিকা (৫৬) বলেন, ‘মুকাদ্দাস নিখোঁজ হওয়ার ১১ বছর পার হলো। আমি এখনো ছেলের ফেরার অপেক্ষায় থাকি। আশায় থাকি, হয়তো একদিন মুকাদ্দাস ফিরবে।’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আল মুকাদ্দাস ঢাকায় যান। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে আল মুকাদ্দাস ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার ওয়ালিউল্লাহ রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকা থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। বাসটি সাভারের নবীনগর এলাকায় পৌঁছালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৮ থেকে ১০ জন আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে নামিয়ে নিয়ে যান। মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ ক্যাম্পাসে না ফেরায় তাঁদের বন্ধুরা পরিবারকে জানান। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজির করেও তাঁদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

ওই বাসের সুপারভাইজার মো. সুমন নিখোঁজ ওই দুই ছাত্রের পরিবারকে জানিয়ে ছিলেন, রাত ১২টার দিকে নবীনগর এলাকায় বাস থামিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজন তাঁদের (আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ) বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যান। ৬ ফেব্রুয়ারি মুকাদ্দাসের নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর চাচা আবদুল হাই রাজধানীর দারুসসালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়ালিউল্লাহর নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর বড় ভাই খালেদ সাইফুল্লাহ আশুলিয়া থানায় একটি জিডি করেন।

এরপর নিখোঁজ দুই ছাত্রের পরিবার পুলিশ, র‍্যাবসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও সন্ধান না পেয়ে হাইকোর্টে দুটি রিট করে। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ দুই ছাত্রের পরিবারের করা বন্দী প্রদর্শন রিটের শুনানি হয়। শুনানি শেষে gfচ মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে কেন আদালতে সশরীর হাজির করা হবে না, জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন এবং স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজিপিসহ ৯ কর্মকর্তাকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে নির্দেশ দেন। নির্ধারিত সময়ে ওই ৯ কর্মকর্তা আদালতকে জানান, তাঁরা ওই দুই নিখোঁজ ছাত্রের সন্ধান পাননি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে আল মুকাদ্দাসের বাবা আবদুল হালিম বলেন, ‘মুকাদ্দাস আমার প্রথম সন্তান। অনেক আদরের সন্তান নিখোঁজ হওয়ার পর আমার পরিবারে কোনো আনন্দ নেই। সন্তান হারানোর বেদনা মা-বাবা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না।’