ধান বেড়ে ওঠার সময়ে সুনামগঞ্জে ঝড়-শিলাবৃষ্টি, চিন্তায় কৃষক

সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরে এখন সবুজ ধানের সমারোহ। জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরেফাইল ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে গতকাল সোমবার রাতে ঝড়ের সঙ্গে ব্যাপক শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে ঝড়বৃষ্টিতে হাওরের বোরো ধান নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকেরা। গত তিন থেকে চার দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তাঁদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।

আর মাসখানেক পরই শ্রমে-ঘামে হাওরে ফলানো ধান গোলায় তুলবেন কৃষকেরা। তবে এই বোরো ফসল নিয়ে সব সময়ই চিন্তায় থাকতে হয় তাঁদের। এ সময় হাওর এলাকায় বৃষ্টি, উজানের পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যার শঙ্কা থাকে। যদি এসবের কোনো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়, তাহলে কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যায়।

জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওরপাড়ের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। এখন ধানের শিষ আসছে মাত্র। এ অবস্থায় ভারী বৃষ্টি হলে সর্বনাশ। তার ওপর ব্যাপক শিলাবৃষ্টি হয়েছে। বুঝতে পারছি না এবার কী হবে।’

হাওরপাড়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। এই হালকা বৃষ্টি ধানের জন্য ভালো ছিল। ধানগাছে ফুল আসার সময় হালকা বৃষ্টি উপকারী। এতে চাল হৃষ্টপুষ্ট হয়। গত তিন দিন সুনামগঞ্জে রোদ কম ছিল। আবহাওয়া ছিল ঠান্ডা। এগুলো ধানের জন্য ক্ষতিকর। এই সময়ে ভারী বৃষ্টি শুধু ধানের ক্ষতি নয়, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলোকে দুর্বল করে দেবে। এতে হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়বে।

গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রথমে ঝড় শুরু হয়। এরপর হয় বজ্রসহ শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টি ছিল টানা। শিলার আকারও ছিল বড়। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, রাতে যেভাবে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, শিলা পড়েছে, তাতে ফসলের অবশ্যই ক্ষতি হবে। তিনি এখনো হাওরে যাননি, গেলে বুঝতে পারবেন কী অবস্থা।

একই উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের কৃষক আবদুল গণি আনসারী বলেন, গত রাতের পরিস্থিতিতে কৃষকদের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ভরা বর্ষায় এমন ভারী বৃষ্টি হয়। এখনো তো ধানে পুরোপুরি শিষ আসেনি। তার আগেই যদি হাওরে পানি চলে আসে, তাহলে তো কপাল পুড়বে।

হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘২০১৭ সালে সুনামগঞ্জের হাওরে যে বিপর্যয় হয়েছিল, তার শুরুটা হয় ২৭ মার্চ থেকে। তখন ভারী বৃষ্টি, উজানের ঢলে একে একে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে সব হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। গত রাতে যে বিরূপ আবহাওয়া দেখলাম, তাতে ২০১৭ সালের ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা মনে পড়ল। হাওরে এবার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজও যথাযথভাবে হয়নি। এ কারণে ভয়টা আরও বেশি।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৩৭টি হাওর ও বিলে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। হাওর এলাকার কৃষকেরা নির্বিঘ্নে এই ধান গোলায় তুলতে পারলে তার বাজারমূল্য হবে ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা। আগামী ১৫ এপ্রিল থেকে হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতে হাওরে ধানের অবস্থা ভালো। সব হাওরেই খোঁজ রাখা হচ্ছে। এখন ভারী বৃষ্টি ফসলের জন্য ক্ষতিকর।  

সুনামগঞ্জে আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতিবছর প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ৪০টি হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। এবার জেলার ১২টি উপজেলায় ৭৩৫টি প্রকল্পে ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে। এতে প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। গত ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। পরে সময় আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়। তবে এখনো কিছু কিছু প্রকল্পে কাজ চলছে বলে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাওর বাঁচাও আন্দোলন সংগঠনের নেতারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও  হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. মামুন হাওলাদার বলেন, ‘বাঁধের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হয়েছে। এখন বাঁধগুলোর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, আমরা সেদিকে লক্ষ রাখছি। যেখানেই কোনো সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কাজে কোনো অবহেলা বা গাফিলতি নেই।’

সুনামগঞ্জের হাওরে একসময় ঠিকাদারদের মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ হতো। ২০১৭ সালে হাওরে ব্যাপক ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে তখন মামলাও হয়। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওরে বাঁধ নির্মাণে নতুন নীতিমালা করে। ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয় ঠিকাদারদের। কাজে সরাসরি যুক্ত করা হয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য প্রকৃত কৃষক ও স্থানীয় সুবিধাভোগীদের নিয়ে পাঁচ থেকে সাত সদস্যের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) থাকে। একটি পিআইসি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার কাজ করতে পারে।