প্রার্থীকে হত্যার ৫৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও মামলা হয়নি

নিহত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া।
ছবি সংগৃহীত

নরসিংদীর রায়পুরায় গণসংযোগের সময় ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়াকে পিটিয়ে হত্যার ৫৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও আজ শুক্রবার রাত আটটা পর্যন্ত মামলা হয়নি। পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো লিখিত অভিযোগ পায়নি তারা। অন্যদিকে স্বজনেরা বলছেন, রাজনৈতিক এ হত্যাকাণ্ডের আসামিদের চিহ্নিত করতে সময় লাগছে। এ ছাড়া প্রসবের অপেক্ষায় থাকা সুমনের স্ত্রী লিজাকে নিয়ে হাসপাতালে ব্যস্ত তাঁরা।

আরও পড়ুন

গত বুধবার দুপুরে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী ইউনিয়নে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালানোর সময় প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হন তালা প্রতীকের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া। ওই সময় জমির আল ধরে দৌড়ে পালিয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের পার্শ্ববর্তী বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের পুলিশ ফাঁড়িতে যান তিনি। পরে বিকেল ছয়টার দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় থানা-পুলিশের সদস্যরা রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়ার মৃত্যুর এ ঘটনায় এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন রায়পুরা উপজেলা পরিষদের সব পদের নির্বাচন স্থগিত করেছে।

নিহত সুমন মিয়া উপজেলার চরসুবুদ্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিনের ছেলে। তিনি অ্যাগ্রো ফার্ম, পোলট্রি ফিড, মাছের খামারের ব্যবসা করতেন। নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন। বিয়ের ১৬ বছর পর তাঁর স্ত্রী লিজা আক্তারের গর্ভে যমজ বাচ্চা এসেছে, আজই রাজধানীর একটি হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা রয়েছে। অনাগত সন্তানদের মুখ দেখার দুই দিন আগেই সুমন মিয়া নিহত হলেন।

আরও পড়ুন

এখনো মামলা না করার বিষয়ে সুমন মিয়ার বাবা ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা করতে এখনো যাইনি, তবে দ্রুতই যাব। পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। যেহেতু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, তাই রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যাপার আছে। আসামিদের নাম-পরিচয় চিহ্নিত করতেও সময় লাগছে। এ ছাড়া ছেলের বউ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় আছে। তাকে নিয়েও আমরা ব্যস্ত আছি।’

পুলিশ বলছে, ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গ থেকে সুমন মিয়ার লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে বাদ আসর সেরাজনগর এমএ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠ ও বাদ মাগরিব চরসুবুদ্দি ঈদগাহ মাঠে দুই দফা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের মামলা করতে আসার জন্য বারবার বলা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দ্রুতই তারা মামলা করতে আসবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ নিয়ে থানায় আসেননি।

রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাফায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা নিহত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়ার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। লিখিত অভিযোগ পেলেই তা মামলা হিসেবে নেওয়া হবে। যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তাদের প্রত্যেকেই গ্রেপ্তার হবে। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে, পাশাপাশি গ্রেপ্তারের অভিযানও চলছে।’

পুলিশের ভাষ্য, এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত আল আমিন ও বাছেদ মিয়া নামের দুই ব্যক্তিকে গতকাল দুপুরে অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়েছে। মামলা না হওয়ায় তাঁদের এ ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখানো যায়নি। পরে বিকেলে ১৫৪ ধারায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়, আদালত ওই দুজনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। চশমা প্রতীকের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসানের মামাতো ভাই আল আমিন ও মামা বাছেদ মিয়া।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, রায়পুরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের সব প্রার্থী দুটি প্যানেলে ভাগ হয়ে এলাকায় এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। একটি প্যানেল সংসদ সদস্য রাজিউদ্দীন আহমদের। ওই প্যানেলে রয়েছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী লায়লা কানিজ, ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমন মিয়া ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী জোসনা বেগম। এ কারণে অপর চেয়ারম্যান প্রার্থী ফেরদৌস কামাল ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসান আরেকটি প্যানেল তৈরি করে প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। স্বাভাবিকভাবেই সংসদ সদস্যের আশীর্বাদপুষ্ট প্যানেল শক্তিশালী হয়ে যায়। এই প্যানেলে প্রতিটি প্রচার-প্রচারণায় সংসদ সদস্যপুত্র রাজীব আহমেদ উপস্থিত থাকতেন। ফলে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় অপর প্যানেল পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ারম্যান প্রার্থী ফেরদৌস কামাল ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবিদ হাসানের ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ বন্ধ পান এই প্রতিবেদক। ঘটনার পর থেকে তাঁরা এলাকায়ও অবস্থান করছেন না। ফলে বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

অপর চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ বলেন, ‘সুমনকে এভাবে চলে যেতে হবে, ভাবতেই পারি না। তাঁর অনাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই পিতৃহারা হলো, স্ত্রী হলো স্বামীহারা। তাদের কীভাবে সান্ত্বনা দেব, ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না। সুমন হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার চাই।’
একই দাবি জানিয়ে সংসদ সদস্যপুত্র রাজীব আহমেদ বলেন, ‘একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কারও পক্ষে এই বিচার করা সম্ভব নয়। তাই তাঁর কাছেই আমরা বিচার দাবি করছি। নিরাপত্তাহীনতায় থেকে আমাদের রাজনীতি করতে হচ্ছে।’