ঈদে দেশে ফেরার কথা ছিল, চলে গেলেন না ফেরার দেশে

দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশিদের বহনকারী গাড়িটি লরির নিচে চাপা পড়ে
ছবি” সংগৃহীত

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আবুল হোসেন (৪৫) ভাগ্য বদলের আশায় দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়েছিলেন ১৩ বছর আগে। সেখানে স্থানীয় এক নারীকে বিয়ে করলেও পরে বিচ্ছেদ হয় দুজনের। একমাত্র সন্তান নাদিম হোসেনকে (১০) নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। নানা কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পর আর দেশে আসেননি আবুল হোসেন। দিন পাঁচেক আগে হঠাৎ তাঁর বাবাকে ফোন দিয়ে বলেন, ছেলে নাদিম হোসেনকে নিয়ে ঈদুল ফিতরের সময় বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু ঈদে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁর। গতকাল শুক্রবার দক্ষিণ আফ্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় আবুল হোসেন ও তাঁর ছেলে নাদিমের।

একই দুর্ঘটনায় আবুল হোসেন ও নাদিম ছাড়া আরও তিন বাংলাদেশি মারা গেছেন। নিহত পাঁচজনের বাড়ি ফেনী জেলায়। স্বজনেরা জানিয়েছেন, নিহত ব্যক্তিদের সবার ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে আসার কথা ছিল।

আজ শনিবার সকালে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার দক্ষিণ চর মজিলিশপুর গ্রামে নিহত আবুল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাতম চলছে। আবুল হোসেনের বাবা জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁর তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় আবুল হোসেন। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল আবুল হোসেনের হাতেই। নিয়মিত দেশে টাকা পাঠাতেন তিনি। আবুল হোসেনের টাকায় একটি পাকা বাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে।

ফেনী সদর উপজেলার বিরলী গ্রামে নিহত ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে স্বজনের মাতম
ছবি: প্রথম আলো

জামাল উদ্দিন বলেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ছেলে আর দেশে আসেনি। হঠাৎ করে বলল আমার নাতিকে নিয়ে দেশে আসবে। আমার ছেলের আর আসা হলো না। আমার নাতিরও মুখ দেখতে পারলাম না। গতকাল দুপুরে এক আত্মীয় ফোন করে জানালেন আমার ছেলে-নাতি আর নেই।’ ছেলে আবুল হোসেন ও নাতি নাদিম হোসেনের লাশ দেশে আনতে সরকারের সহযোগিতা চান তিনি।

দুর্ঘটনায় নিহত ইসমাইল হোসেনের (৩৮) বাড়ি সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নে। তাঁর ঘরেও গতকাল দুপুর থেকে চলছে মাতম। তাঁর স্বজনেরা বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে ইসমাইল দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। তাঁর এক ভাইকে নিয়ে সেখানে একটি দোকান পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। তাঁর বিয়ের কথা চলছিল। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন ও বিয়ের উদ্দেশ্যে ঈদের কয়েক দিন আগে তাঁর দেশে আসার কথা ছিল।

নিহত পাঁচ বাংলাদেশি
ছবি: সংগৃহীত

নিহত মোস্তফা কামালের বাড়ি ফেনীর জায়লস্কর ইউনিয়নে দক্ষিণ নেয়াজপুর গ্রামে। তাঁর ভাই মোস্তফা জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোস্তফা ১২ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। জানিয়েছিলেন, ঈদের সময় বাড়ি আসবেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। পরিবারকে নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল।’

দুর্ঘটনায় নিহত রাজু আহমেদের বাড়ি দাগনভূঞার মাতুভূঞা ইউনিয়নের মমারিজপরে। স্বজনদের বরাত দিয়ে স্থানীয় মাতুভূঞা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লা আল মামুন বলেন, ঈদের সময় বাড়ি ফিরবেন তাই মৃত্যুর আগের দিনও রাজু তাঁর স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কার জন্য কী নিয়ে আসবেন। স্বজনদের জন্য এরই মধ্যে কিছু কেনাকাটা শেষ করেছেন বলেও জানিয়েছিলেন।

দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি জানতে পরে ফেনী জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা নিহতদের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। এ বিষয়ে ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নিজে নিহত ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে গিয়েছেন। নিহত অন্য ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের লাশ দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

স্থানীয় সময় গতকাল ভোররাতে ওয়েস্টার্ন কেপ প্রদেশের লোকানকায় এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিশুসহ পাঁচজন নিহত হন। দুর্ঘটনায় দুই বাংলাদেশি আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রিটোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে এসব তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রিটোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের দূতালয়প্রধান মো. কামরুল আলম খান প্রথম আলোকে জানান, ওই বাংলাদেশিদের বহনকারী একটি প্রাইভেট কার ওয়েস্টার্ন কেপ থেকে কেপটাউন বিমানবন্দরে যাচ্ছিল। গাড়িটি বেফুর্ট ওয়েস্ট শহরের অদূরে লোকানকা নামের এলাকায় এলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। গাড়িটি একটি লরির নিচে ঢুকে যায়। ঘটনাস্থলে পাঁচজনের মৃত্যু হয়।